সমাজকল্যাণ প্রশাসন কি? সমাজকল্যাণ প্রশাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা কর।

অথবা, সমাজকল্যাণ প্রশাসন কাকে বলে? সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রশাসনের উদ্দেশ্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, সমাজকল্যাণ প্রশাসনের সংজ্ঞা দাও। সমাজকল্যাণ প্রশাসনের লক্ষ্যসমূহ লিখ।
অথবা, সমাজকল্যাণ প্রশাসনের কাকে বলে। সমাজকল্যাণ প্রশাসনের লক্ষ্যসমূহ লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকল্যাণ প্রশাসন পেশাদার সমাজকর্মের একটি সহায়ক পদ্ধতি। এর উৎপত্তি মূলত সমাজসেবামূলক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা থেকে। এটি সমাজকর্মের মৌল পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়নে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলিকে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে সহায়তা করে। সমাজকল্যাণ প্রশাসন সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্তর করে তার মূল্যায়ন ও সংশোধন করার সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া।
সমাজকল্যাণ প্রশাসন : সাধারণত সমাজকল্যাণ প্রশাসন বলতে সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে নির্দেশ করে, যেগুলো প্রত্যক্ষভাবে সমাজকল্যাণ বা সমাজসেবামূলক কার্যাবলির সাথে সংশ্লিষ্ট। সমাজকল্যাণ প্রশাসন সামাজিক নীতি ও
আইনের আলোকে জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য সমবেত কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা করে থাকে। একে সমাজকর্ম প্রশাসন বা সামাজিক প্রশাসন নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সমাজকল্যাণ প্রশাসন সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলঃ
রাসেল এইচ. কার্ট এর মতে, “সমাজকল্যাণ প্রশাসন সামাজিক নীতিকে সামাজিক সেবায় রূপান্তরিত করার এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে নীতি বা পদ্ধতি সংশোধন করা হয়।” জন. সি. বিডনী এর মতে, “সমাজকল্যাণ প্রশাসন হচ্ছে সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় পরিণত করার এবং
সামাজিক নীতির সংশোধন ও ফলাফল মূল্যায়নের বিশেষ প্রক্রিয়া।”
ডব্লিউ. এ. ফ্রিডল্যান্ডার এর মতে, “সমাজকল্যাণ প্রশাসন হচ্ছে সামাজিক প্রতিষ্ঠান সংগঠিত ও পরিচালনা করার
প্রক্রিয়া।”
ড. ডি. পল চৌধুরীর ভাষায়, “সমাজকল্যাণ প্রশাসন হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও নীতি মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কার্যাবলির বাস্তবায়নে পেশাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হয়।”
পূরণের মোটকথা, সমাজকল্যাণ নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যে প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় বা পরিচালনা করা হয় তাকেই সমাজকল্যাণ প্রশাসন বলে। পরিকল্পনা ও কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক নীতি বাস্তব রূপ লাভ করে। পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কৌশলই হচ্ছে সমাজকল্যাণ প্রশাসন।
সমাজকল্যাণ প্রশাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতিসমূহকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগে সহায়তা করাই সমাজকল্যাণ প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। তবে সমাজকল্যাণ প্রশাসনের আরও কতিপয় সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য রয়েছে যা নিম্নে উল্লেখ করা হল ঃ
১. সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্তরিত করা : সমাজকল্যাণ প্রশাসন হচ্ছে সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া । কাজেই নীতিকে সেবায় রূপান্তরিত করা সমাজকল্যাণ প্রশাসনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
২. সুসংগঠিত সেবা প্রদান : আধুনিক সমাজকল্যাণ সমাজসেবা ও প্রতিষ্ঠানের সুসংগঠিত পদ্ধতি। সংগঠন ছাড়া এ ধরনের সেবা প্রদান করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, প্রশাসন ব্যতিরেকে সুষ্ঠুভাবে সংগঠন পরিচালনা করা মোটেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ সুসংগঠিত সেবা প্রদানের জন্য সমাজকল্যাণ প্রশাসন অপরিহার্য। কাজেই বলা যায় সুসংগঠিত সেবা প্রদান করাও সমাজকল্যাণ প্রশাসনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
৩. কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন : কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপান্ত রিত করা সম্ভব। কাজেই সামাজিক নীতির আলোকে বা স্তবমুখী কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা সমাজকল্যাণ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
৪. কর্মী নির্বাচন : সংগঠন পরিচালনা, কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী নির্বাচন করাও সমাজকল্যাণ প্রশাসনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
৫. কর্মীদের প্রশিক্ষণ : নির্বাচিত কর্মীদেরকে উপযুক্ত ও দক্ষকর্মী হিসেবে গড়ে তোলা এবং হাতে কলমে শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং তত্ত্বাবধান করা সমাজকল্যাণ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
৬. জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা : সমাজকর্ম যেসব সংগঠনের মাধ্যমে সেবাপ্রদান করে তাদের মূল উদ্দেশ্য জনগণের কল্যাণ সাধন করা। তাই জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা সমাজকল্যাণ প্রশাসনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
৭. প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জন : বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য সমাজকল্যাণ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করা সমাজকল্যাণ প্রশাসনের বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
৮. সমন্বয় সাধন করা : সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের মধ্যে এবং কর্মরত অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাও সমাজকল্যাণ প্রশাসনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
৯. প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ : সমাজকল্যাণ প্রশাসন শুধু সংগঠন পরিচালনাই করে না বরং পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদও আহরণ করে থাকে।
১০. নীতি ও পদ্ধতির সংশোধন : বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সামাজিক নীতি ও সমাজসেবা পদ্ধতির পরিবর্তন ও সংশোধন সমাজকল্যাণ প্রশাসনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
১১. আত্মনির্ভরশীল করা : সাহায্য গ্রহীতাদের নিজ শক্তি সামর্থ্যের ব্যবহারের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়তা করা।
১২. জনগণের অংশগ্রহণ : সেবাপ্রদানমূলক কর্মকাণ্ডে জনসাধারণের সম্পৃক্ত করা এবং উন্নয়নের সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া।
১৩. কর্মচারীদের তত্ত্বাবধান : প্রশাসন সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং তাঁদের ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন করা।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্রধান প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্যই সমাজকল্যাণ প্রশাসন পরিচালনা করা হয়। সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণ হতে শুরু করে কর্মসূচির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পর্যন্ত দীর্ঘ গতিশীল কর্মপ্রবাহ পরিচালিত করে থাকে সমাজকল্যাণ প্রশাসন।