সমাজকল্যাণ প্রশাসন কাকে বলে? সমাজকল্যাণ প্রশাসনের কার্যাবলিগুলো আলোচনা কর।

উত্তর ঃ ভূমিকা : সমাজকল্যাণ প্রশাসন এমন একটি কার্যক্রম যা প্রতিটি ব্যক্তি বিভিন্নভাবে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। এটা সহযোগিতামূলক কাজ, পরিব্যাপক কাজ প্রতিটি ব্যক্তি এতে অংশ নেয় এবং প্রত্যেকেই এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। সমাজকল্যাণ প্রশাসন মূলত বহুমুখী কার্য সম্পন্ন করে। সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে বিভিন্ন কার্য সম্পন্ন করে। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সেবায় মান উন্নতকরণে সচেষ্ট হয়। প্রশাসন বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা হচ্ছে সামাজিক প্রশাসন সমাজ সেবা ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা থেকে এর উৎপত্তি।
সমাজকল্যাণ প্রশাসন : সামাজিক প্রশাসন এমন একটি কলা যার মাধ্যমে কোনো উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যার্জনের জন্য কোনো এজেন্সী বা সংগঠনের কার্যাবলিকে নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করা হয়। মোঃ আবদুল হালিম মিয়ার মতে, সামাজিক প্রশাসনের প্রধান কাজ হচ্ছে সমাজকল্যাণমূলক কাজের অগ্রগতি
নিশ্চিত করার জন্য সমবেত কার্যক্রম গ্রহণ করে। এজন্য সামাজিক প্রশাসন সমাজকর্মীদের নিকট সমাজকল্যাণ প্রশাসন
নামে পরিচিত। সমাজকল্যাণ প্রশাসন সামাজিক নীতি ও আইনের আলোকে জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্য সমবেত
কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিকল্পনা করে থাকে।
Social work year book এর মতে, সমাজকল্যাণ প্রশাসন হলো সামাজিক নীতিকে সমাজসেবায় রূপদানের এমন
এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সামাজিক নীতির মূল্যায়ণ ও সংশোধন করা হয়। সর্বোপরি, সামাজিক প্রশাসন হলো লোক প্রশাসনের একটি শাখা বিশেষ যা সামাজিক নীতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিয়োজিত । এটি সমাজকর্মের একটি সহায়ক পদ্ধতি যা সামাজিক নীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করে।
→ সমাজকল্যাণ প্রশাসনের কার্যাবলি : সমাজকল্যাণ প্রশাসন বহুমুখী কার্য সম্পন্ন করে। সুষ্ঠু ও সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে বিভিন্ন কার্য সম্পন্ন করে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সেবায় মান উন্নত করাই এর কাজ।
N.N Hossain এবং M. Alauddin তাঁর Introduction to social work methods. গ্রন্থে সমাজকল্যাণ প্রশাসনের ১১টি কার্যক্রম উল্লেখ করেছেন- সেগুলো নিম্নরূপ :
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ : কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের প্রথম এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ হলো প্রশাসনিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা।
২. সাংগঠনিক রূপদান করা ঃ সংগঠনে যে সকল কর্মী নিয়োজিত কেবল তারাই সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়ন দায়িত্ব ও কর্তৃত্বদানে ভূমিকা পালন করে। এ ধরনের সংগঠনের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয়। যেমন-
(ক) ব্যবস্থাপনা ও ব্যয়ের দিক থেকে সরল ও কম ব্যয়বহুল ।
(খ) এর সেবা কার্যক্রম ও প্রক্রিয়ার মধ্যে সমতা থাকা উচিত।
(গ) এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কর্মসম্পর্কিত জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয় ।
(ঘ) এজেন্সীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয় ।
(ঙ) বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রম সম্পর্কে একটি স্পষ্ট দায়িত্ব পালন চিত্র থাকা উচিত।
(চ) দ্বৈত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সুস্থ আন্তঃক্রিয়া থাকা বাঞ্ছনীয়।
(ছ) যারা প্রতিষ্ঠানের নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমিকা পালন করে, তাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত।
(জ) এতে পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ণ ও পর্যালোচনা থাকা উচিত।
(ঝ) সময় ও প্রয়োজনের সাথে সাথে সাংগঠনিক কাঠামো নমনীয় ও বিজ্ঞানমুখী হওয়া উচিত। সর্বোপরি, সাংগঠনিক কাঠামোতে কাজ করার মতো উত্তম কর্মপরিবেশ থাকা, যা কর্মীদের নৈতিক মান উন্নয়নে সহায়তা দান করতে পারে।
৩. কর্মসূচি উন্নয়ন ঃ কর্মসূচি প্রতিষ্ঠানের সেবাকে নির্দেশ করে। কর্মসূচির মাধ্যমে একটা প্রতিষ্ঠান তার লক্ষ্যে পৌঁছায় । সমাজকল্যাণ প্রশাসনে সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানে গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়।

  1. বাজেটিং ঃ একটি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে আলাদা আলাদাভাবে আয়-ব্যয়ের খাত লিপিবদ্ধ করে পাঠায় যাতে.সঠিকভাবে কার্য সম্পন্ন হয়। সমাজকল্যাণ প্রশাসনে বাজেটিং প্রতিষ্ঠানের সম্পদ সঞ্চালন বণ্টন এবং নিয়ন্ত্রণ করে থাকে । যাতে প্রতিষ্ঠান তার বাঞ্ছিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারে।
    ৫. কার্যক্রম পরিচালনা : সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা প্রশাসনের অন্যতম কাজ। সংগঠনের কর্মীরা যাতে সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারে। এজন্য তত্ত্বাবধায়ক নেতৃত্বদান করে থাকে। তারা সংগঠনের সমন্বয় সাধন করা, কর্মীদের ইচ্ছা শক্তি বাড়ায় এবং সহযোগিতামূলক মনোভাবের সাহায্যে সংগঠনকে এগিয়ে নেয়।
    ৬. সমন্বয় ঃ সমন্বয় যেকোনো প্রতিষ্ঠানে ফলপ্রসূ কর্ম হিসাবে গণ্য হয় এবং এর সাহায্যে সংগঠন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। কেননা এর সাহায্যে সংগঠনের সকল শাখা প্রশাখা সুষম ভূমিকা পালনের সুযোগ লাভ করে।
    ৭. তত্ত্বাবধান : তত্ত্বাবধান সমাজকল্যাণ প্রশাসনে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এটি কর্মীদের কাজ দেখা বা শুধু.তদারকি নয়। এর সাথে তাদের কাজ করার দক্ষতা, উন্নয়ন জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে দক্ষতার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটানো, জ্ঞানের গভীরতা সৃষ্টি করা এবং মান বৃদ্ধি করা। সুতরাং, তত্ত্বাবধান একটি শিক্ষামূলক প্রক্রিয়া।
    ৮. জনসংযোগ : সমাজকল্যাণ সেবার অর্থই জনগণের স্বার্থে জনগণের জন্য কাজ করা। জনগণের সর্বোত্তম সেবা দান করা। সমাজকল্যাণ সেবার মাধ্যমে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। যাতে এ ধরনের সেবার ক্ষেত্রে জনগণের সমর্থন থাকে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। প্রশাসনে জনসংযোগ বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন এজেন্সীর মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন অটুট হয়।
    ৯. গবেষণা ও মূল্যায়ন : ধারাবাহিক মূল্যায়ন একটি প্রশাসনের মৌলিক কাজ যা ঐ সংগঠনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের সাথে কার্যক্রমের সম্পর্ক বা বন্ধন সৃষ্টি করে। গবেষণা ও মূল্যায়ণের মাধ্যমে সংগঠন চারটি উপকার পেয়ে থাকে।
    (ক) গবেষণা ও মূল্যায়ণ এজেন্সীর প্রচলিত সেবা উন্নয়নের সাহায্য করে।
    (খ) জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন নতুন সেবা চালুকরণ।
    (গ) জনগণের কাজ করার পদ্ধতি উন্নয়ন এবং
    (ঘ) ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে সহায়তা করা।
    ১০. নিবন্ধীকরণ এবং প্রতিবেদন : উত্তম প্রশাসনের জন্য রেকর্ডপত্র মূল্যায়ণ গুরুত্বপূর্ণ। কর্মসূচি ব্যবস্থাপনা, অর্থায়ন, কর্মসূচি ও নীতি নির্ধারণে নিবন্ধীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা নিবন্ধীকরণ মূল্যায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা । প্রতিবেদনের মাধ্যমে এজেন্সী সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও এজেন্সীর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অবহিত হয়ে থাকে। এ
    প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার এজেন্সী তাদের কার্যধারা সম্পর্কে অবহিত হয়ে থাকে। যা এজেন্সীর যাবতীয় কার্যক্রমের ব্যাখ্যা এবং এজেন্সীর প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন বৃদ্ধি ঘটে।
    ১১. সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন : এজেন্সীর সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে সামাজিক প্রশাসনটি সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।
    উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ নীতি ও কর্মসূচিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য সমাজকল্যাণ প্রশাসন গড়ে তোলা হয়েছে। যদিও সমাজকল্যাণ প্রশাসন অনেক পুরনো। তাই বর্তমান যুগের জটিল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রশাসন প্রায় অচল। তাই সামাজিক সংস্কার অত্যন্ত জটিল। সাংগঠনিক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের কাঠামো উন্নত করতে হবে। মূলত এটি জনকল্যাণ সাধনের
    একটি প্রত্যক্ষ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া।