অথবা, সমাজকর্ম পদ্ধতির শ্রেণি বিভাগ লিখ। সমাজকর্ম পদ্ধতির নীতিমালা বর্ণনা কর।
অথবা, সমাজকর্ম পদ্ধতির ধরণগুলো লিখ। সমাজকর্ম পদ্ধতির মূলনীতি বর্ণনা কর।
অথবা, সমাজকর্ম পদ্ধতির ধরণগুলো আলোচনা কর। সমাজকর্ম পদ্ধতির মূলনীতি
আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : কোন কার্য সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদনের উপায়কে পদ্ধতি বলা হয়। সমাজকর্ম একটি আধুনিক সাহায্যকারী পেশা। ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সমাধানে এর নিজস্ব কতকগুলো পদ্ধতি রয়েছে। আধুনিক সমাজকর্ম তার নিজস্ব পদ্ধতিগুলো অনুসরণের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান প্রচেষ্টা চালায়। ব্যক্তি, দল কিংবা সমষ্টির সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ সহায়তা প্রদান করা সমাজকর্ম পদ্ধতির মূল লক্ষ্য।
সমাজকর্ম পদ্ধতি (Social work method) : পেশাদার সমাজকর্মীগণ ব্যক্তি, দল বা সমষ্টির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে যেসব বিশেষ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকেন সেসব পদ্ধতিগুলোকে সমাজকর্ম পদ্ধতি ‘Social work method’ বলা হয়। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, পেশাদার সমাজকর্মীগণ যেসব পদ্ধতি বা কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে
সমাজকর্ম বিষয়ক জ্ঞান, দক্ষতা ও নীতিমালা বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকেন তাকে সমাজকর্ম পদ্ধতি বলা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সমাজকর্ম পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল :
এইচ.বি. ট্রেকার (H.B. Tracker) বলেছেন, “Social work methods may be defined as the integrated arrangement of knowledge, understanding and principles of social work which serve as the concious and designed means of achieving the goals of social work.” অর্থাৎ, সমাজকর্ম পদ্ধতিকে সমাজকর্মের সুসংবদ্ধ জ্ঞান, উপলব্ধি এবং নীতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যা সচেতন এবং নির্ধারিত উপায়ে সমাজকর্মের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।
ড. আব্দুল হাকিম সরকার তাঁর ‘ব্যক্তি সমাজকর্ম নির্দেশিকা’ (২০০০: ১৯-২০) গ্রন্থে সমাজকর্ম পদ্ধতির সংজ্ঞায়নে “যেসব কর্মপন্থা বা কর্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা এবং নীতিমালা ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির
সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার ক্ষেত্রে কর্মী প্রয়োগ করে থাকেন সেসব সুশৃঙ্খল কর্ম প্রক্রিয়ার সমষ্টিই সমাজকর্ম পদ্ধতি।” উপরিউক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধান বা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পেশাদার সমাজকর্মীগণকে যেসব সুশৃঙ্খল পদ্ধতি, কৌশল, পন্থা বা উপায় অবলম্বন করতে হয় তাকে সমাজকর্ম পদ্ধতি বলে ।
সমাজকর্ম পদ্ধতির সাধারণ নীতিমালা : সমাজকর্ম পদ্ধতিগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেসব নীতিমালা অনুসরণ করতে হয় সেগুলোই সমাজকর্ম পদ্ধতির সাধারণ নীতিমালা। নিম্নে সমাজকর্ম পদ্ধতির সাধারণ নীতিমালা আলোচনা করা হলঃ
১. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার : মানুষ নিজেই তার নিজের ভাগ্য নির্মাতা। আর মানুষকে তার নিজের ভাগ্য নির্মাণে সুযোগ প্রদান বা অধিকার দান হল আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার। আমরা জানি, সমাজকর্ম একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া। একটি সক্ষমকারী প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যক্তি, দল বা সমষ্টি নিজেই যাতে নিজের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয় সমাজকর্ম সে নীতিতে বিশ্বাস করে। এ কারণে সমাজকর্ম পদ্ধতিগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধনের উপর গুরুত্বারোপ করে এবং সে অনুযায়ী তাকে সক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে।
২. ব্যক্তির মূল্য ও মর্যাদার স্বীকৃতি : সমাজকর্ম বিশ্বাস করে যে সমাজের প্রতিটি মানুষেরই একটি বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে। সমাজের প্রত্যেক মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে তার আত্মমর্যাদার স্বীকৃতি প্রদানই এর মূল কথা। সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল মানুষ। আর মানুষ হিসেবে সমাজের প্রত্যেকেই পৃথক মর্যাদা ও সত্তার অধিকারী। সমাজকর্ম বিশ্বাস করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্
রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষেরই এ মর্যাদা রয়েছে। সকলকে নিয়েই
সমাজ। সমাজে প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষেরই অবদান রয়েছে।
৩. সকলের সমান সুযোগ : সমাজের সকল মানুষকে সমান সুযোগ ও সমান অধিকার প্রদান করতে হবে। এটা সমাজকর্মের একটা অন্যতম নীতি ও মূল্যবোধ। যোগ্যতার বিচারে মানুষকে বিচার করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য
মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে অধিকারগুলো প্রয়োজন সেগুলো প্রত্যেককেই দিতে হবে, অর্থাৎ যে খাদ্য, বস্ত্র,
বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিত্তবিনোদনের অধিকার সকলেরই রয়েছে। এখানে ছোট বড়, ধনী গরিব, ধর্ম ও বর্ণের কোন ভেদাভেদ নেই।
৪. স্বনির্ভরতা অর্জন : সমাজকর্মের একটি অন্যতম নীতি হল স্বনির্ভরতা অর্জন। স্বনির্ভরতা অর্জন মানে নিজের উপর নির্ভর করে চলার ক্ষমতা অর্জন। অপরের দয়া দাক্ষিণ্য ছাড়া নিজ প্রচেষ্টায় ও নিজ সামর্থ্য সক্ষমতা অর্জনকে বলা হয় স্বনির্ভরতা। সমাজকর্ম বিশ্বাস করে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। এ সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশ সাধন ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়, স্বনির্ভরতা অর্জনও সম্ভব নয়। আর সুপ্ত ক্ষমতার বিকাশের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ I
৫. গণতান্ত্রিক অধিকার : সমাজকর্মের পদ্ধতিগুলোর অপর একটি সাধারণ নীতিমালা হল গণতান্ত্রিক অধিকার। এটি
এমন এক নীতি যে নীতিতে বিশ্বাস করা হয় মানুষ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করবে, সমান অধিকার ভোগ করবে, ন্যায়বিচার পাবে এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে আইনের চোখে সকলেই সমান।
৬. শ্রমের মর্যাদা : সমাজকর্ম পদ্ধতিগুলোর সাধারণ নীতিগুলোর অপর একটি হচ্ছে শ্রমের মর্যাদা প্রদান। সমাজকর্ম প্রত্যেক প্রকার শ্রমের মর্যাদা দানে বিশ্বাসী। সমাজকর্ম বিশ্বাস করে সমাজের উন্নয়নে সকল প্রকার শ্রমেরই মর্যাদা রয়েছে। একজন রাষ্ট্রপতির শ্রমের যেমন মর্যাদা রয়েছে, একজন প্রশাসক, একজন শিক্ষক, একজন জেলে, একজন ঝাড়ুদার এমনকি একজন মেথরেরও শ্রমের মর্যাদা রয়েছে। এর কারণ প্রশাসক ছাড়া দেশ শাসন সম্ভব নয়, দেশের শান্তিরক্ষা সম্ভব
নয়, শিক্ষক ছাড়া দেশকে, দেশের মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়, একজন কৃষকের কৃষিকাজ ছাড়া আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দেওয়া সম্ভব নয়, একজন জেলে বা কসাই ছাড়া আমরা মাছ মাংস পেতে পারি না, তাঁতী তাঁত না বুনলে আমরা আমাদের পোশাক পেতে পারি না, একজন মেথর ও ঝাড়ুদার ছাড়া পরিবেশ দূষণ রোধ সম্ভব নয়। সুতরাং সকল পেশাজীবী মানুষই সমাজের জন্য অপরিহার্য।
৭. সম্পদের সদ্ব্যবহার : সমাজকর্ম সম্পদের সদ্ব্যবহার নীতিতে বিশ্বাস করে। সমাজে দু’প্রকার সম্পদ রয়েছে। যথা :
ক. বস্তুগত সম্পদ ও খ. অবস্তুগত সম্পদ।
সম্পদের সদ্ব্যবহার বলতে সমাজে প্রাপ্ত বস্তুগত ও অবস্তুগত সকল প্রকার সর্বোত্তম ও বিকল্প ব্যবহারকে বুঝায়। সমাজকর্ম ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টির উন্নয়নের জন্য সম্পদের সদ্ব্যবহার নীতিতে বিশ্বাস করে। সম্পদ ব্যক্তিগত, দলীয় কিংবা সমষ্টিগত হতে পারে কিংবা রাষ্ট্রীয়, প্রাকৃতিক, জাতীয় হতে পারে। এসব সম্পদ যথাযথভাবে আহরণ করতে হবে ও তা কাজে লাগাতে হবে।
৮. পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা : মানুষের সামাজিক ভূমিকা পালন ও পদমর্যাদা অনুযায়ী সম্মান প্রদর্শনই হল শ্রদ্ধাবোধ। আর কারও কথা বা আচরণ বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হলেও তা সহ্য করার মত ধৈর্য হল সহনশীলতা। একটি চমৎকার, সুন্দর ও অনুপম সমাজ গঠনের জন্য মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা থাকতে হবে। সমাজে ছোট বড় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বাস করে, যারা বড় এবং যারা ভালো পদমর্যাদায় রয়েছেন তাদেরকে অবশ্যই শ্রদ্ধা
করতে হবে।
৯. সামাজিক দায়িত্ব : সমাজের এক মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের যে দায়িত্
ব রয়েছে তাকে সামাজিক দায়িত্ব বলে। এটা পালন করা সমাজকর্ম পদ্ধতিগুলোর একটি সাধারণ নীতি। অপরের দুঃখে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে, সামষ্টিক কল্যাণে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং সমাজের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। এভাবে সামাজিক দায়িত্ব
পালন করতে হবে।
১০. সামগ্রিক জীবনবোধ : সমাজকর্মের একটি উল্লেখযোগ্য নীতি হচ্ছে এটি সমাজের সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে বিশ্বাসী । সমাজকর্ম সমাজের সকল মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি সকল দিকের কল্যাণে বিশ্বাস করে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজকর্মের উপরিউক্ত নীতিগুলো মেনে চলার মাধ্যমে সমাজকর্মের অনুশীলন করা হয়। উপরিউক্ত নীতিগুলো অনুসরণ করলে সমাজের সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।