সমাজকর্ম পদ্ধতির সংজ্ঞা দাও। সমাজকর্ম পদ্ধতির বিকাশ আলোচনা কর ।

অথবা, সমাজকর্ম পদ্ধতি কাকে বলে? সমাজকর্ম পদ্ধতির পটভূমি লিখ।
অথবা, সমাজকর্ম পদ্ধতি বলতে কি বুঝ? পদ্ধতিগুলো কি কি? সমাজকর্ম পদ্ধতির উৎপত্তি বা ইতিহাস বর্ণনা কর।
অথবা, সমাজকর্ম পদ্ধতি কি? এ পদ্ধতির বিকাশ ধারা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্ম হচ্ছে একটি সাহায্যকারী পেশা। সমাজকর্ম পদ্ধতি হল সমাজকর্ম অনুশীলনের অধ্যম। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে অর্জিত তাত্ত্বিক জ্ঞান সংগ্রহের মাধ্যমে সমাজকর্ম নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুশীলন করে কে। এটি বিশেষ কতকগুলো পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে মানুষকে সাহায্য করাই
এর মূল লক্ষ্য।
সমাজকর্ম পদ্ধতি : সমাজকর্ম পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জনের জন্য প্রথমেই জানা প্রয়োজন পদ্ধতি কি। কোন কাজ সুশৃঙ্খল উপায়ে সম্পন্ন করতে যে পন্থার সাহায্য নিতে হয় তা-ই হচ্ছে পদ্ধতি। সমাজকর্ম পদ্ধতি বলতে সেসব কর্মপন্থা ও কর্ম প্রক্রিয়াকে বুঝায় যার মাধ্যমে সমাজকর্মের জ্ঞান, দক্ষতা এবং নীতিমালা ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টির সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মীরা অনুশীলন করে থাকেন। অন্যভাবে বলা যায়, স্থান-কাল-অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি, দল ও জনসমষ্টির সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও সমাধানে পেশাগত সেবা প্রদানের জন্য সমাজকর্মে যে সুশৃঙ্খল কৌশল অনুশীলন করা হয়, সেসব পন্থা বা উপায় হচ্ছে সমাজকর্ম পদ্ধতি।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সমাজকর্ম পদ্ধতি সম্পর্কে প্রামাণ্য সংজ্ঞা নিম্নে প্রদান করা হল :
এইচ. বি. ট্রেকার (H. B. Tracker) এর মতে, “পদ্ধতি বলতে কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি সচেতন ও সুপরিকল্পিত উপায় বুঝায়। বাহ্যিকভাবে পদ্ধতি হল কিছু করার পন্থা এবং এর অন্তরালে রয়েছে জ্ঞান, বুদ্ধি ও সুনির্দিষ্ট
কর্মনীতির এক সমন্বিত বিন্যাস।”
আমেরিকার জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি (NASW) এর ভাষায়, “ব্যক্তি অথবা দলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে (সমাজকর্মী) নিজেকে দায়িত্বশীল, সচেতন ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজে লাগানো হল সমাজকর্ম পদ্ধতি। অনুশীলনকারী এরূপ সম্পর্কের মাধ্যমে পারস্পরিক ক্রিয়াগত প্রভাবে, অবিরত সচেতনতা আনয়নসহ ব্যক্তি ও পরিবেশের মধ্যে কষ্ট লাঘবকর মিথস্ক্রিয়ার ব্যবস্থা করে।”
একজন চিকিৎসক যেমন রোগীর রোগ নিরাময় করে থাকে, তেমনি পেশাদার সমাজকর্মী সমাজের রোগ বা সমস্যার
সমাধান করে থাকেন। আর এজন্য তিনি (সমাজকর্মী) সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকেন। সমাজকর্মে যেসব পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ায় সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়ে থাকে সেগুলো মূলত কতিপয় নীতি ও মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত বস্তুগত ও অবস্তুগত সেবা।
তাই সমাজকর্ম পদ্ধতি বলতে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি, দল বা জনসমষ্টির প্রতিকার, প্রতিরোধ ও উন্নয়নের জন্য পেশাদার সমাজকর্মী কর্তৃক অনুসৃত নির্ধারিত পন্থা বা কর্ম-কৌশলকে বুঝায়।
সমাজকর্মের পদ্ধতিসমূহ : ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যার বিভিন্নতার প্রেক্ষিতে সমাজকর্মের সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ায় প্রধানত দু’ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যথা ঃ
ক. মৌলিক পদ্ধতি এবং
খ. সহায়ক বা সাহায্যকারী পদ্ধতি ।
ক. মৌলিক পদ্ধতি আবার তিন ভাগে বিভক্ত। যথা :
১. ব্যক্তি সমাজকর্ম,
২.
দল সমাজকর্ম এবং
৩. সমষ্টি সংগঠন ও সমষ্টি উন্নয়ন।
খ. সহায়ক পদ্ধতিও তিন ভাগে বিভক্ত। যথা :
১. সমাজকর্ম পদ্ধতি,
২. সমাজকল্যাণ প্রশাসন ও
৩. সামাজিক কার্যক্রম।
সমাজকর্ম পদ্ধতিসমূহের বিকাশ : সমাজকর্মের পদ্ধতিসমূহ বাস্তবক্ষেত্রে সমাজকর্মের জ্ঞান প্রয়োগের হাতিয়ার যার মাধ্যমে ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করে গঠনমূলক আর্থসামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করা হয়। সমাজকর্মের ছয়টি পদ্ধতির বিকাশ তথা উৎপত্তির ইতিহাস নিম্নে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হল ঃ
১. ব্যক্তি সমাজকর্ম : ব্যক্তি সমাজকর্মের মূল উৎস ১৮৬০ এর দশকে ইংল্যান্ডে এবং ১৮৭৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষিতে আমেরিকায় গড়ে উঠা দান সংগঠন আন্দোলন। ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রথম প্রকাশিত হয় মেরি রিচমন্ড প্রণীত ‘Social Diagnosis’ গ্রন্থে। তিনি ব্যক্তি সমাজকর্মের নীতি হিসেবে ব্যক্তি এবং পরিবারকে সমস্যা সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ একক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ১৯২০ সাল হতে ১৯৩০ সালের মধ্যে প্রখ্যাত মনঃসমীক্ষক ফ্রয়েড প্রণীত
মনোবিজ্ঞানের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলন পদ্ধতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে গৃহীত হয়।
মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে মেরি রিচমন্ড মত পোষণ করেন, সমাজকর্মীদের সমস্যার প্রতিকার এবং
প্রতিরোধের প্রতি যুগপৎভাবে গুরুত্বারোপ করতে হবে। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ব্যক্তি সমাজকর্ম নির্দিষ্ট জ্ঞানভাণ্ডারে সমৃদ্ধ হয়ে বিকাশ লাভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি তার সমস্যা এবং সামঞ্জস্য বিধান সম্পর্কে উপলব্ধি করা। ১৯২৯ সালে মিলফোর্ড অধিবেশনে ব্যক্তি সমাজকর্মকে আরও সুদৃঢ় করা হয়। এই রিপোর্টের অধিবেশনের রিপোর্টে
উল্লেখ করা হয়- ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা এবং ব্যক্তি সমাজকর্মীদের কৌশল সকল ক্ষেত্রের জন্যই মূলত অভিন্ন।
২. দল সমাজকর্ম : চার্চের পৃষ্ঠপোষকতায় দলভিত্তিক কার্যক্রম প্রথম শুরু হয়েছিল ১৮৫৫ সাল হতে ১৮৬৫ সালের মধ্যে । বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বয়স্কাউট, গার্লস গাইড, ওয়াই.এম.সি.এ, ওয়াই. ডব্লিউ.সি.এ, সেটেলম্যান্ট হাউস প্রভৃতি দল কর্মসংস্থা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে সংগঠিত হলে দল সমাজকর্মের ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ‘মানসিক হাসপাতাল’ ও ‘চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক’ মানসিক অসুস্থ ও ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসার্থে চিত্তবিনোদনমূলক কর্মসূচি চালু করলে দল সমাজকর্ম আধুনিক রূপ ধারণ করতে শুরু করে। এ সময়েই বিভিন্ন দলীয় কার্যক্রম যেমন- শিক্ষা, খেলাধুলা, আলোচনা প্রভৃতিতে শুধু অংশগ্রহণের গুরুত্ব না দিয়ে এগুলো কিভাবে ব্যক্তির বিকাশে সহায়তা করে তার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
১৯২৯ সালে ব্যক্তি সমাজকর্ম সমাজকর্মের পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সমাজকর্মীরা দলীয় কর্মকে বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করা শুরু করে। ১৯৩৫ সালে সমাজকর্মের জাতীয় অধিবেশনে ‘দল সমাজকর্ম কি?’ নামে একটি নিউজলেটার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে দল সমাজকর্মকে সমাজকর্মের পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্ক’ সাথে সাথেই দলকর্মীদের পেশাগত শিক্ষার জন্য পাঠ্যসূচি তৈরি করে।
৩. সমষ্টি সংগঠন ও উন্নয়ন : সমষ্টি সংগঠনের সূত্রপাত্র হয়েছে মূলত যুক্তরাষ্ট্রের দান সংগঠন আন্দোলন (COM) থেকে। স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণসহ বিভিন্ন জনকল্যাণ কর্মসূচিতে বিশেষ করে ১৯৩০ এর অর্থনৈতিক মন্দার সময় ‘কমিউনিটি কাউন্সিল’ ও ‘কমিউনিটি চেস্ট’ যে অবদান রাখে তা জনগণের মাঝে ব্যাপক আস্থা সৃষ্টি করে এবং সংগঠিত সমষ্টি কর্মসূচি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩৯ সালে আমেরিকায় অনুষ্ঠিত ‘National Conference of Social
Work’ সমাজকর্মের পদ্ধতি ও প্রয়োগক্ষেত্র হিসেবে সমষ্টি সংগঠনের উপর গুরুত্ব আলোচনা হয়। ১৯৪৪ সালের মধ্যে সমষ্টি সংগঠন সমাজকর্মের শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৬ সালে এর পেশাগত প্রয়োগের লক্ষ্যে Association for Study of Community Organization’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৫০ সালে আটলান্টিক সিটিতে
অনুষ্ঠিত সমাজকর্মের জাতীয় সম্মেলনে সমষ্টি সংগঠনকে সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ।
৪. সমাজকল্যাণ প্রশাসন : সামাজিক প্রশাসনের উৎপত্তি মূলত সমাজসেবামূলক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা থেকে। পরবর্তীতে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমশক্তির চাহিদা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে পেশাদার কর্মীর চাহিদা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সমাজব্যবস্থা প্রভৃতি সামাজিক প্রশাসনের বিকাশে সহায়তা করে। সার্বিক সমাজকর্ম
অনুশীলনের গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হিসেবে প্রশাসন স্বীকৃত।
৫. সমাজকর্ম গবেষণা : গবেষণা পেশাদার সমাজকর্ম অনুশীলনের অপরিহার্য অঙ্গ। ১৯৪০ সালের দিকে প্রশাসন এবং গবেষণা এ দু’টি সহায়ক প্রক্রিয়া সমাজকর্ম অনুশীলন পদ্ধতির অংশ হিসেবে বিকাশ লাভ করে। ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম, সমষ্টি সংগঠন, প্রশাসন ও গবেষণা সমাজকর্ম অনুশীলনের এ পাঁচটি পদ্ধতি বিকাশের সাথে সমাজকর্মকে স্বতন্ত্র পেশার পরিচিতি দানের জন্য সমন্বিত অনুশীলন পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়ত দেখা দেয়।
৬. সামাজিক কার্যক্রম : ১৯৫১ সালে আর্নেস্ট হলিস এবং এ্যালিক টেলর সমাজকর্মের শিক্ষা কার্যক্রমে সামাজিক কার্যক্রমের উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করে। পরিকল্পিত পরিবর্তনের কৌশল হিসেবে সমাজকর্ম অনুশীলনে সামাজিক কার্যক্রম প্রয়োগ করা হয়। একে সামাজিক পর্যায়ে সমাজকর্ম অনুশীলনের কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে উদ্ভাবিত সমাজকর্মের দর্শন ও পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যার প্রতিকার। সমাজকর্ম অনুশীলনে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কৌশল ও পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে। ব্যক্তি, দল ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে উদ্ভব হয়েছে তিনটি মৌলিক পদ্ধতি- ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম ও সমষ্টি সংগঠন পদ্ধতি। মৌলিক পদ্ধতিকে সহায়তা করার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে সাহায্যকারী পদ্ধতি- সমাজকল্যাণ প্রশাসন, সমাজকর্ম গবেষণা ও সামাজিক কার্যক্রম। বর্তমানে সমাজকর্ম অনুশীলনে চালু হয়েছে সমন্বিত পদ্ধতি।