সমাজকর্মে সমাজসংস্কারের গুরুত্ব কী?

অথবা, সমাজকর্মে সমাজসংস্কারের তাৎপর্য কী?
অথবা, সমাজকর্মে সমাজসংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কী আলোচনা কর?
অথবা, সমাজকর্মে সমাজসংস্কারের প্রভাবগুলো কী কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্মের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা। সমাজসংস্কারকগণ যুগে যুগে আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজকর্ম অনুশীলনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছে। সমাজকর্মে সমাজসংস্কারের গুরুত্ব অত্যধিক। এ প্রসঙ্গে M.S Gore বলেছেন, “সামাজিক, অর্থনৈতিক বা কল্যাণমূলক কার্যাবলির ক্ষেত্রে সকল ব্যবস্থাই সমাজ সংস্কারকদের দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত।”
সমাজকর্মে সমাজসংস্কারের গুরুত্ব : নিম্নে সমাজকর্মে সমাজসংস্কারের গুরুত্ব বা অবদান আলোচনা করা হলো :
১. সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা : সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে সমাজসংস্কার সহায়তা করে। সমাজকর্মে পরিবেশ তৈরিতে বাধা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন কুসংস্কার, কু-প্রথা, ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রভৃতি দূরীকরণে সমাজসংস্কার আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ বাল্যবিবাহ, বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সমাজ সংস্কার আন্দোলন অপরিহার্য।
২. বাঞ্ছিত সামাজিক পরিবর্তন আনয়ন : সমাজসংস্কারের মাধ্যমে সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনয়ন করা সম্ভব। এমনকি এর মাধ্যমে সমাজের ক্ষতিকর প্রথা বা দোষ-ত্রুটির সংশোধন এমনকি প্রয়োজনে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করা যায়। ফলে সুস্থ সমাজ কায়েম করা যায় সহজেই।
৩. অধিকারবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ : অধিকারবঞ্চিত জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণে সমাজসংস্কারের ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মানবিক অধিকার প্রদান এবং তাদের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে সমাজ সংস্কার আন্দোলন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। সমাজসংস্কার আন্দোলন অধিকারহারাদের পাশে থেকে কাজ করে থাকে।
৪. আর্থ-সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি : সমাজকর্মের কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত আর্থ সামাজিক
পরিবেশ। সমাজসংস্কার উপযুক্ত আর্থ-সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। যেমন- ১৯৬১ সালের মুসলিম
পারিবারিক আইন, ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন, ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি আইন সমাজকর্মের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
৫. সমস্যা সমাধানে জনমত তৈরি : সমাজের ক্ষতিকর প্রথা দূরীকরণে প্রথমেই দরকার হয় জনমত তৈরি। সমাজসংস্কার আন্দোলন জনমত তৈরিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। তাই সমাজের অনাকাঙ্ক্ষিত রীতি-নীতি ও
মূল্যবোধসমূহ দূরীকরণে সমাজ সংস্কারের পক্ষে জনমত তৈরি করে সামাজিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে।
৬. জনগণকে সচেতন করা : সমাজসংস্কার আন্দোলনের ফলে জনগণ সচেতন হয়ে উঠে। ফলে সমাজের কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি হ্রাস পায়। সমাজসংস্কার আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণের ফলে নতুন করে অবাঞ্ছিতকর অবস্থা সহজেই সৃষ্টি হতে পারে না।
৭. সামাজিক আন্দোলন : সমাজসংস্কার আন্দোলন সামাজিক আন্দোলনে রূপ নেয়। এক্ষেত্রে সমাজকর্মের সামাজিক কার্যক্রম পদ্ধতির সঙ্গে এর মিল রয়েছে। এর ফলে সমাজ থেকে সামাজিক সমস্যা হ্রাস পায় এবং সমাজে শান্তির সুবাতাস বইতে থাকে।
৮. কর্মসূচির বাস্তবায়ন : সমাজের মানুষের জন্য বিভিন্ন সমাজকর্ম কল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। সমাজকর্মের এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমাজসংস্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই সমাজকর্মে সমাজ
সংস্কারের গুরুত্ব অত্যধিক।
৯. জনগণের অংশগ্রহণ : সমাজসংস্কার আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। জনগণের অংশগ্রহণ ব্যতীত সমাজসংস্কার আন্দোলনের সফলতাও আশা করা যায় না। জনগণের অংশগ্রহণের ফলে সামাজিক সমস্যার সমাধানও দ্রুত হয়।
১০. সার্বিক কল্যাণ : সমাজসংস্কার আন্দোলন পরিচালনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণ তথা সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা। তাই জনকল্যাণের লক্ষ্যেই সমাজসংস্কারের পদক্ষেপ নেয়া হয় ।
১১. বিবিধ : এছাড়া আরও নানা কারণে সমাজকর্মে সমাজসংস্কারের গুরুত্ব রয়েছে। এগুলো হলো সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সামাজিক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সমাজব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, সামাজিক নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রভৃতি। এককথায় সমাজসস্কারের গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না।
উপসংহার : সমাজসংস্কারের গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। অসহায়, নির্যাতিত নারী ও শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজসংস্কার আন্দোলন পূর্বে ছিল বর্তমানেও রয়েছে। সমাজকর্মের পূর্ণতা আনয়নে একে অস্বীকার করার উপায় নেই ।