অথবা, সমাজকর্ম পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগ বলতে কি বুঝ? একজন পেশাদার সমাজকর্মীর গুণাবলি ও দায়িত্ব লিখ।
অথবা, সমাজকর্ম পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগ কি? পেশাদার সমাজকর্মীর পরিচয় ও কর্তব্য সম্পর্কে লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজকর্ম ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিকে সাহায্য করার একটি পেশাদার সেবাকর্ম। সমাজকর্ম পদ্ধতি হচ্ছে সমাজকর্মের এমন এক সুসংবদ্ধ জ্ঞান, উপলব্ধি ও নীতির সমষ্টি যা সচেতন ও পরিকল্পিত উপায়ে তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে থাকে। বর্তমান সময়ের ব্যস্ততম সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ধরনের জটিল সমস্যার উদ্ভব ঘটে থাকে। এসব জটিল সমস্যার সমাধানে সমাজকর্ম পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগ অপরিহার্য।
সমাজকর্মের সমন্বিত পদ্ধতি : তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকর্ম পদ্ধতিকে প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত করা
হয়। যথা : মৌলিক পদ্ধতি এবং সহায়ক পদ্ধতি। মৌলিক পদ্ধতিকে ব্যক্তি সমাজকর্ম, দল সমাজকর্ম এবং সমষ্টি সংগঠন ও উন্নয়ন এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আবার সহায়ক পদ্ধতিকেও সমাজকল্যাণ প্রশাসন, সমাজকর্ম গবেষণা ও সামাজিক কার্যক্রম এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
আধুনিক সমাজকর্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে কোন সমস্যার স্থায়ী ও ফলপ্রসূ সমাধান আনয়নের লক্ষ্যে সমাজকর্মের মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতির সমন্বয়ে সমন্বিত পদ্ধতিভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। কারণ সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণায় কেবল একটি পদ্ধতির সাহায্যে ব্যক্তি বা সমষ্টির সমস্যার স্থায়ী ও গঠনমূলক সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। যে কারণে সমাজ সম্পর্কিত সমাজবিজ্ঞানীদের নিস্তর গবেষণার ফলশ্রুতিতে সমাজকর্মের মৌলিক ও সহায়ক পদ্ধতির সমন্বয়ে সমন্বিত পদ্ধতি নামে একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
সমাজকর্মের এই সমন্বিত পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে বিভিন্ন ধরনের জটিল সামাজিক সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে। বিশেষ করে যে কোন সমাজের আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে সমাজকর্ম পদ্ধতির সমন্বিত প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। সমন্বিত পদ্ধতি প্রয়োগের যুক্তি হিসেবে আরও বলা যায়- সমাজকর্মের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সমস্যার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সমস্যার প্রভাব, বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যার প্রেক্ষাপট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, কোন সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আবার তেমনি ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগের পাশাপাশি সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ব্যক্তির
জন্য দল সমাজকর্ম বা সমষ্টি সমাজকর্ম প্রয়োগেরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আবার এরই সাথে সাথে ঐ একই ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে সহায়ক পদ্ধতি যেমন- সমাজকল্যাণ প্রশাসন, সমাজকর্ম গবেষণা এবং সামাজিক কার্যক্রম পদ্ধতির গুরুত্বও কম নয়। বর্তমানে আধুনিক বিশ্বে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সমন্বিত সমাজকর্ম পদ্ধতির
ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এইচ. বি. ট্রেকারের সুস্পষ্ট মন্তব্য হচ্ছে, “সবগুলো পদ্ধতিই প্রয়োজনীয় এবং সবগুলোই পরস্পর সম্পর্কিত।” সমাজকর্মের প্রতিটি পদ্ধতির মূল কেন্দ্র হচ্ছে ব্যক্তি। কিন্তু ব্যক্তির অবস্থান এবং সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে সৃষ্ট সমস্যার প্রেক্ষিতে একক পদ্ধতির প্রয়োগ জটিল ব্যাপার। কারণ মানুষের সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক
অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত থাকায় পদ্ধতিগুলোর সমন্বিত প্রয়োগ ছাড়া সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান আশা করা যায় না। এজন্যই
আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে বর্তমানে সমন্বিত পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
পেশাদার সমাজকর্মীর পরিচিতি ও ভূমিকা : সাহায্যার্থীরা তাদের সমস্যাকে বুঝতে এবং নিজস্ব শক্তি সামর্থ্য দিয়ে তার মোকাবিলা করার মাধ্যমে সমস্যাকে
কাটিয়ে উঠার লক্ষ্যে সমাজকর্ম তার কার্যক্রম পরিচালনা করে
থাকে। সাহায্যার্থীর সমস্যা সমাধানের উপায় ও সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রয়োজন এমন একজন কর্মীর যিনি বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে সাহায্যার্থীকে সমস্যা মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলতে পারে। সমাজকর্মে এ ধরনের কর্মীকে বলা হয়। পেশাদার সমাজকর্মী। সমাজকর্মীর পরিচিতি সমাজকর্ম পদ্ধতির অনুসরণ ও প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় সমাজকর্মী বলতে সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগকারীকে বুঝায়।
পেশাদার সমাজকর্মীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব পালনে সচেতনতা এবং ভূমিকা পালনকারীর দক্ষতার উপর সমাজকর্মের কার্যকারিতা, সফলতা ও বিফলতা নির্ভর করে। কেননা এর মাধ্যমে সমাজকর্মীর আত্ম-উপলব্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি আসে, দায়িত্ববোধ জন্মে এবং ভূমিকা পালনের মানসিকতা ও সক্ষমতা গড়ে ওঠে। সাহায্যার্থীকে সমস্যা মোকালিায় সক্ষম করে তোলার ক্ষেত্রে পেশাদার সমাজকর্মীকে বহুমুখী ও বিচিত্র ভূমিকা পালন করতে হয়। নিম্নে পেশাদার সমাজকর্মীর ভূমিকা তুলে ধরা হল ঃ
১. পথ-প্রদর্শনকারী : পেশাদার সমাজকর্মী সাহায্যার্থীর পথ-প্রদর্শনকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে। সাহায্যার্থী সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে সমাজকর্মীর দ্বারস্থ হয়। সমাজকর্মী তাকে সমস্যা সমাধানে সঠিক পথের সন্ধান
দিয়ে থাকে।
২. সক্ষমকারী: সমাজকর্মীর অন্যতম কাজ হল অক্ষমকে সক্ষম করে তোলা। এজন্য সমাজকর্মীকে অবশ্যই সক্ষম হতে হবে। যেহেতু সমাজকর্মী নিজে কাজকর্মে সক্ষম, সেজন্য সাহায্যার্থীর সমস্যা কাটিয়ে তাকে সক্ষম করে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে।
৩. সমর্থনকারী : পেশাদার সমাজকর্মী একজন সমর্থনকারীর ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়। সাহায্যার্থীকে গ্রহণ ও সমর্থন দান করেন। সাহায্যার্থীকে সমর্থনদানের মাধ্যমে তার সমস্যা সমাধানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহায়তা করেন।
৪. পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নকারী : সমাজকর্মী সাহায্যার্থীকে সক্ষম করে তোলার জন্য পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকে। কর্মসূচি প্রণয়ন করেই শুধু ক্ষান্ত হন না, এর বাস্তবায়নও ঘটিয়ে থাকে।
৫. সমন্বয়কারী : বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্বও সমাজকর্মীর উপর ন্যস্ত থাকে। সাহায্যার্থী, কর্মসূচি, সমাজকর্মী এ তিনের সমন্বয়ে ব্যক্তি বা সমষ্টির সমস্যা সমাধান সম্ভব হয়।
৬. সাহায্যকারী : সমস্যা যেহেতু ব্যক্তি বা সমষ্টির, তাই সমাজকর্মী এক্ষেত্রে সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে। সমস্যা নির্ণয় থেকে শুরু করে সমাধান পর্যন্ত সাহায্য অব্যাহত থাকে সমাজকর্মীর।
৭. নেতৃত্বদানকারী : সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মীকে নেতার ভূমিকা পালন করতে হয়। এজন্য সমাজকর্মীকে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করতে হয়। ফলশ্রুতিতে সমষ্টির জন্য কর্মসূচি দিতে গিয়ে তাকে নেতৃত্ব দান করতে দেখা যায় ।
৮. পরামর্শদানকারী : পেশাদার সমাজকর্মী সমস্যাগ্রস্ত ও অভাবগ্রস্তদের বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয় ধরনের সাহায্য দিয়ে থাকে। অবস্তুগত সাহায্য বলতে পরামর্শদানকেই বুঝিয়ে থাকে।
৯. নিরাপত্তাদানকারী : ব্যক্তি বা সমষ্টির আর্থসামাজিক নিরাপত্তা প্রদানে সমাজকর্মী বদ্ধপরিকর। এজন্য তাকে নিরাপত্তাদানকারী বলা হয়।
১০. গবেষক : সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মীকে প্রয়োজনে গবেষণামূলক কাজে অবতীর্ণ হতে হয়। এজন্য তথ্য সংগ্রহ করা সমাজকর্মীর অন্যতম কাজ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ব্যক্তি ও সমষ্টির সমস্যা সমাধানে পেশাদার সমাজকর্মী বিভিন্ন সময়ে সমাজকর্মের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকেন। তাই স্থান-কাল-পাত্রভেদে সমাজকর্মীর ভূমিকা বহুমুখী ও বিচিত্র হতে পারে।