অথবা, সমাজকর্মের একটি স্বতন্ত্র পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে
বর্ণনা কর ।
অথবা, সমাজকর্মের একটি স্বতন্ত্র পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের উদ্ভবের ইতিহাস
লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ব্যক্তি সমাজকর্ম সমাজকর্মের একটি মৌলিক পদ্ধতি। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিকে
বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সাহায্য করার জন্য পেশাদার সমাজকর্মীগণ যে পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন তাই ব্যক্তি সমাজকর্ম। ব্যক্তি
সমাজকর্মকে অন্য সকল পদ্ধতির মূল বলে আখ্যায়িত করা হয়। ব্যক্তি সমাজকর্ম একদিনে বিকাশ লাভ করে নি, বরং বিভিন্ন প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ সমাজকর্ম অনুশীলনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি সমাজকর্ম একটি বিশেষ পদ্ধতি হিসেবে মর্যাদা লাভ করে।
সমাজকর্মের স্বতন্ত্র পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের বিকাশ : ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি একদিনে গড়ে উঠে নি। মানুষের প্রয়োজন, চিন্তাচেতনা ও গবেষণার ফলশ্রুতিতে ব্যক্তি সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধান ব্যবস্থার
মাধ্যমেই ব্যক্তি সমাজকর্ম বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ব্যক্তি সমাজকর্মের আবির্ভাব ঘটে মূলত শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তি সমাজকর্ম কর্মসূচি মূলত Family case work. child welfare, medical treatment, school social work ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে বিকাশ লাভ করে। নিম্নে সময়ের প্রয়োজনে ব্যক্তি সমাজকর্মের বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. ইংল্যান্ডে COS গঠন : ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ‘The Society for Organizing Charitable Relief and Repressing Mendicity’ গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে দরিদ্রদের মধ্যে সাহায্য দানের ব্যবস্থা করা হয়। সংস্থাটি পরবর্তীতে ‘Charity Organizing Society’ সংক্ষেপে COS নামে পরিচিতি লাভ করে। সংস্থাটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে দরিদ্রতা সম্পর্কে অনুসন্ধান ও দরিদ্রদের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা চালায়। এভাবে COS ব্যক্তি সমাজকর্মের ভিত্তিভূমি রচনা করে।
২. আমেরিকায় AICP গঠন : ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় ‘Association for Improving the Conditions of the Poor’ সংক্ষেপে AICP গঠিত হয়। এ সংস্থার অন্যতম লক্ষ্য ছিল দরিদ্রদের গৃহপরিদর্শনের মাধ্যমে তাদের
উপদেশ ও নির্দেশনা প্রদান, কর্মসংস্থানের জন্য অনুপ্রেরণা দান এবং তাদের ভিতরে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা।
৩. আমেরিকায় COS গঠন : ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের অনুকরণে Charity Organization Society বা COS গঠিত হয়। এ সংস্থার কার্যক্রম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রীকরণ ও ব্যক্তি সমাজকর্মের বিকাশকে অনেকটা দ্রুত ও গতিশীল করে। এ সংগঠনের প্রধান পরিকল্পনা ছিল, (ক) সাহায্যের জন্য দরখাস্তকারীদের অবস্থার অনুমোদন করে তাদের সমস্যা ও
চাহিদা নির্ণয় করা, (খ) কেন্দ্রীয় রেজিস্ট্রি বোর্ড গঠন করে দরিদ্রের তালিকা প্রণয়ন, (গ) সাহায্যগ্রহীতাদের রেকর্ড সংরক্ষণ, (ঘ) ত্রাণ বিতরণ এবং (ঙ) স্বেচ্ছাসেবীদের পরিবার পরিদর্শন নিয়োজিত করা।
৪. আমেরিকায় জাতীয় কনফারেল : ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় ‘National Conference of Charities and Corrections’ অনুষ্ঠিত হয়। এই Conference এ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যীকরণ নীতির উপর বিভিন্ন প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এসব প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য ছিল :
ক. ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুসন্ধান চালানো,
খ. ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা পালন ক্ষমতার পুনরুদ্ধারের উপর গুরুত্বারোপ এবং
গ. ত্রাণসামগ্রীর উপর নির্ভরতাকে কমিয়ে আনা ।
এসব প্রতিবেদনের মধ্যেও ব্যক্তি সমাজকর্মের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়।
- School of Social Work প্রতিষ্ঠা : ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নিউইয়র্ক সমাজকর্মের উপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলে ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। নিউইয়র্কের School of Social Work-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমাজকর্মীরা সেবাপ্রার্থীদের সমস্যা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতির বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রশিক্ষণার্থী পরিদর্শকদের (Visitor in training) অনুসন্ধান, সমস্যা নির্ণয়, সমাধান, পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রভৃতির উপর বিশেষজ্ঞরা নির্দেশনা দান করেন।
৬. পরিবার কল্যাণ সমিতি গঠন: COS আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯০৫ সালে আমেরিকায় ‘Family Welfare Association’ বা পরিবার কল্যাণ সমিতি গঠিত হয়। মনীষী Mary Richmond যিনি ব্যক্তি সমাজকর্মের তাত্ত্বিক উদ্ভাবক হিসেবে খ্যাত (Conceptual Founder of Social Case Work) এবং মনীষী Francis H. McKlean ছিলেন পরিবার সেবা সমিতির (Family Service Societies) অগ্রদূত। এ সমিতি ব্যক্তিগত সেবাপ্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমিতির উদ্যোগে Social Case Work শিরোনামে জার্নালও প্রকাশিত হয়।
৭. মেরি রিচমন্ডের প্রচেষ্টা : ব্যক্তি সমাজকর্মকে সমাজকর্মের একটি পদ্ধতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে Mary Richmond সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ১৯১৭ সালে Social Diagnosis গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তিনি ব্যক্তি সমাজকর্মের পূর্ণাঙ্গরূপ তুলে ধরেন। এ গ্রন্থ প্রকাশের পর ব্যক্তি সমাজকর্ম সমাজকর্মের একটি পদ্ধতি হিসেবে সুসংহত রূপলাভের সুযোগ পায় ।
৮. মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব : সিগমন্ড ফ্রয়েড ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্পর্কে যে তত্ত্ব প্রদান করেন তাই মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব নামে পরিচিত। এই তত্ত্ব প্রদানের ফলে ব্যক্তি সমাজকর্মে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ব্যক্তির মানসিক অবস্থা যাচাই করে তাকে সে অনুযায়ী সহযোগিতা প্রদান করা হয়। ফ্রয়েডের চেতন ও অবচেতন মনের ধারণা ব্যক্তি সমাজকর্মে বিশেষ অবদান রাখে।
৯. মিলফোর্ড কনফারেল : ১৯২১ সালে মিলফোর্ড কনফারেন্স প্রকাশিত “Social Case Work: Genetic and Specific” নামক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ব্যক্তি সমাজকর্মের ধারণা বিশেষভাবে উন্নতি লাভ করে। পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মকে সুসংগঠিত এবং সুশৃঙ্খল কাঠামো প্রদান করার জন্য উক্ত রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আলোচ্য Conference এর সার সংক্ষেপ ১৯২৯ সালে “Social Case Work: Genetic and Specific” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। উক্ত রিপোর্টে ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলনের সবক্ষেত্রে অভিন্ন মৌল জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়। এর ফলে ব্যক্তি সমাজকর্মের ধারণা আরও পাকাপোক্ত হয়।
১০. আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা : ১৯২৯ সালে আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার ফলে সৃষ্ট সমস্যা ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার প্রতি গুরুত্বারোপের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিক সমস্যার প্রতি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি দানের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্তি সমাজকর্মের বিকাশকে ত্বরান্বিত করে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ব্যক্তি সমাজকর্মের বিকাশ একদিনের কোন ঘটনা নয়। সময়ের বিবর্তনে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদার প্রেক্ষাপটে ধীরে ধীরে ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি বিকাশ লাভ করেছে। বলা যেতে পারে COS এর ভিত্তি রচনা করে। এরপর বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ ব্যক্তি সমাজকর্মকে সমাজকর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি হিসেবে স্থান করে নেয়। ১৯৫০ সালের দিকে ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতি ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে। ষাটের দশকে সমাজকর্মের বিশেষ পদ্ধতি হিসেবে ব্যক্তি সমাজকর্মের ব্যাপক প্রয়োগ শুরু হয়।