সমস্যা নির্ণয় বলতে কী বুঝায়? সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়ার শ্রেণিবিন্যাসগুলো কী তা আলোচনা কর ।

অথবা, সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় বলতে কী বুঝায়? সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় কাকে বলে? সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়ার ধরণ আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ব্যক্তি সমাজকর্ম অনুশীলন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হলো মনোসামাজিক সমস্যা নির্ণয়। ব্যক্তি সমাজকর্ম বিকাশের প্রারম্ভিক পর্যায়ে সমস্যা সমাধান পরিকল্পনায় Diagnosis ছিল তিনটির মধ্যে একটি। অন্য দুটি ছিল Study এবং Treatment। সমস্যা নির্ণয় ধারণাটি মূলত চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে নেয়া হয়েছে। Marry Richmond সর্বপ্রথম সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় ধারণাটি উদ্ভাবন করেন। ১৯৭১ সালে তাঁর ‘Social Diagnosis’ গ্রন্থ প্রকাশিত হলে এ ধারণাটি বিস্তার লাভ করতে থাকে।
সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় : সাধারণভাবে বলা যায়, ব্যক্তির সমস্যা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা করে তার সমস্যা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বলা হয় সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়। এটা একটি মানসিক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তি ও তার সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্ন দিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় এবং সমস্যা ও তার প্রকৃতি সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায়। অন্যভাবে বলা যায়, সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় বলতে ব্যক্তি ও তার সমস্যার যাবতীয় তথ্য এবং প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদান
করা সম্ভব এমন ধরনের সাহায্য সংক্রান্ত কর্মপ্রচেষ্টার একটি সুষ্ঠু নকশা বা পরিকল্পনাকে বুঝানো হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সমস্যা নির্ণয় সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো :
The Dictionary of Social Welfare এর সংজ্ঞানুযায়ী, “সাহায্যার্থী ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও সমস্যার সাথে জড়িত অবস্থার সঠিক ও প্রকৃত সংজ্ঞা জানার প্রচেষ্টা হচ্ছে সমস্যা নির্ণয়।”
ড. আব্দুল হাকিম সরকার (২০০০ : ১১৯) বলেছেন, “সমাজকর্ম প্রক্রিয়ায় আভিধানিক অর্থে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় হচ্ছে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বা সাহায্যার্থীর ব্যক্তিত্ব ও তার মনোসামাজিক অবস্থা যা সমস্যার সঠিক সংজ্ঞায় পৌঁছার এক নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে হলে এরূপ বলা যায় যে, এটা এক সচেতন মানসিক কর্মপ্রয়াস যাতে সাহায্যার্থী ব্যক্তির সার্বিক ধারণা, স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান, আন্দাজ, অন্তর্দৃষ্টি ও তার অসম্পূর্ণ চিন্তাভাবনা ইত্যাদি অত্যন্ত
শৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে তার সমস্যার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।”
‘Dictionary of Social Welfare’ গ্রন্থের সংজ্ঞানুযায়ী, “Diagnosis is an attempt to arrive at as exact definition as possible of the social situation and personality of a given client.”
সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়ার শ্রেণিবিন্যাস : ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়াকে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায় । যথা :
১. সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়া (Dynamic diagnostic process),
২. সমস্যা নির্ণয়ে যান্ত্রিক বা চিকিৎসামূলক প্রক্রিয়া (Clinical diagnosis process) এবং
৩. সমস্যা নির্ণয়ে ঐতিহাসিক বা উৎপত্তি সম্বন্ধীয় প্রক্রিয়া (Historical or etological diagnosis process)।
১. সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়া (Dynamic diagnostic process) : ব্যক্তি যে সমস্যায় পড়েছে সে প্রেক্ষিতে যেসব বিষয় বা শক্তিসমূহ পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় সক্রিয় তার একটি বাস্তবধর্মী সামগ্রিক চিত্র দাঁড় করানো ও সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা লাভ করাই হলো সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া যেসব বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে তা হলো :
ক. মূল অসুবিধাটা কি? কি কি সামাজিক, পারিবারিক ও মানসিক উপাদান দ্বারা সমস্যাটি সৃষ্টি করেছে;
খ. ব্যক্তির কল্যাণের উপর এবং অন্যান্যের জীবনে ও কল্যাণের উপর সমস্যাটির ক্ষতিকর প্রভাব;
গ. ব্যক্তি কর্তৃক তার সমস্যার সমাধান প্রত্যাশার ধরন;
ঘ. ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এমনকি কি উপায় বা অনুকূল অবস্থা বর্তমান এবং সমস্যা মোকাবিলায় কিভাবে কর্মসূচি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সংক্ষেপে বলতে গেলে সমস্যা নির্ণয়ের গতিশীল প্রক্রিয়ার কাঠামোতে নিম্নোক্ত তথ্যাবলির প্রয়োজন। যথা :
ক. সমস্যা সংক্রান্ত যাবতীয় প্রাসঙ্গিক তথ্য;
খ. কারণগত উপাদান যা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ,
গ. বিভিন্ন স্তরে সমস্যা মোকাবিলায় ব্যক্তি কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ;
ঘ. বিদ্যমান সম্পদ;
ঙ. ব্যক্তি কি ধরনের সমাধান কামনা করে তার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্যের সম্পর্ক।
সমস্যা নির্ণয়ে গতিশীল প্রক্রিয়ায় সমস্যার বিষয়ে ব্যক্তির মনোদৈহিক ও আর্থসামাজিক কারণ চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তাছাড়া ব্যক্তির কল্যাণের প্রতি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ চিহ্নিত করতে হবে। সেই সাথে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদও চিহ্নিত করতে হবে।
২. সমস্যা নির্ণয়ে যান্ত্রিক বা চিকিৎসামূলক প্রক্রিয়া (Clinical diagnosis process) : ব্যক্তির সমস্যার প্রকৃতি তাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তির শ্রেণিবিন্যাস করার ক্ষেত্রে যান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ধরন, গুণাগুণ, অভিযোজন সংশ্লিষ্ট সমস্যা ইত্যাদি চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ প্রক্রিয়ায়
সামাজিক ভূমিকা পালনে বাধাসৃষ্টিকারী ব্যক্তির আচরণও শনাক্ত করা হয়। এইচ. এইচ. পার্লম্যান (H. H. Perlman) এর
মতে, “যান্ত্রিক বা চিকিৎসাজনিত প্রক্রিয়ায় সাহায্যার্থী ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ধরন, গুণাগুণ, নির্দিষ্ট প্রকৃতি, সামঞ্জস্যবিধান সংক্রান্ত সমস্যা এবং নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনে বাধাদানকারী চাহিদা বা আচরণের প্রকৃতি নির্ণয় করার চেষ্টা চালানো হয়।”
৩. সমস্যা নির্ণয়ে ঐতিহাসিক বা উৎপত্তি সম্বন্ধীয় প্রক্রিয়া (Historical or etological diagnosis process) : সমস্যা নির্ণয়ে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া সমস্যার তাৎক্ষণিক কারণ উদ্ঘাটন করে না। এক্ষেত্রে সমস্যার সূত্রপাত কোথায়, কিভাবে, কখন এবং কার সাথে জড়িত ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। ব্যক্তির সমস্যার কারণ, উৎস, বিকাশ ও প্রভাব সম্পর্কে তথ্য উদ্ঘাটন করা এ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য। এ প্রক্রিয়া ব্যক্তির জীবনের History এবং সমস্যা উৎপত্তি
হওয়ার, History জানার প্রয়াস চালানো হয়। এক্ষেত্রে একজন সমাজকর্মী যেসব বিষয় খেয়াল রাখেন তা হলো :
ক. সমস্যাটি তার পরিবারে অন্য কারো ছিল কি না;
খ. সমস্যাটি কখন ও কিভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে;
গ. ব্যক্তির জীবনে কি এমন ঘটনা ঘটেছে যে সে সমস্যাগ্রস্ত হয়েছে;
ঘ. ব্যক্তির পারিবারিক অবস্থা কেমন;
ঙ. ব্যক্তির সামাজিক অবস্থা কেমন;
চ. ব্যক্তি যাদের সাথে মেলামেশা করেছে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন;
ছ. ব্যক্তির মধ্যে তীব্র কোন ক্ষোভ, হতাশা বা দ্বন্দ্বের কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে কি না এবং তা কোন প্রেক্ষাপটে। সমস্যা নির্ণয়ের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় একজন সমাজকর্মী উপর্যুক্ত বিষয়গুলোকে গভীরভাবে খেয়াল করবেন। এরপর সমস্যার কারণ নির্ণয় করবেন এবং তা সমাধানের ব্যবস্থা করবেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, ব্যক্তির সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় করতে হলে সমাজকর্মীকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। কোন একক প্রক্রিয়া অবলম্বনের মাধ্যমে যেমন সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় করা যায় তেমনি অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ে তিনটি প্রক্রিয়াই অনুসরণ করতে হয়। কারণ সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় অনেকটা জটিল প্রক্রিয়া। সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ে যাতে কোন ভুল না হয় সে কারণে কোন একক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে সবগুলোর সমন্বিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করাই উত্তম।