অর্থবা, সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় ধারণটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ের শ্রেণি বিভাগসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় কী? সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়কে কয়ভাগে ভাগ করা যায়?
উত্তর৷ ভূমিকা : সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় বলতে ব্যক্তি ও সমস্যা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য এবং প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হয় এমন সাহায্য সম্বলিত কর্মপ্রয়াসের একটি সুষ্ঠু নকশা বা পরিকল্পনাকে বুঝায়। অর্থাৎ সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় চিন্তা-পূর্ব চিন্তার এমন এক প্রতিফলন যা সমস্যা সমাধান কার্যক্রমের একটি রূপরেখা প্রণয়নে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়।
সমাজকর্ম প্রক্রিয়ায় আভিধানিক অর্থে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় হচ্ছে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বা সাহায্যার্থীর ব্যক্তিত্ব ও তার মনোসামাজিক অবস্থা বা সমস্যার সঠিক সংজ্ঞায় পৌছার এক নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। এ বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে হলে এরূপ বলা যায় যে, এটি এক সচেতন মানসিক কর্মপ্রয়াস, যাতে সাহায্যার্থী ব্যক্তির সার্বিক ধারণা, স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান, আন্দাজ, অন্তর্দৃষ্টি ও তার অসম্পূর্ণ চিন্তাভাবনা ইত্যাদি অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে গুছিয়ে তার সমস্যার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় : সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় প্রক্রিয়ায় সাধারণত দুটি বিশেষ দিকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়।
১. ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও সমস্যা শনাক্তকরণ (Personality and problem identification) ও
২. সমাধান পরিকল্পনা প্রণয়ন (Formulation of treatment plan)
সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ের জন্য পেশাদার সমাজকর্মীকে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হয় :
১. সমস্যা সংক্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোকে শ্রেণিবিন্যাস করা;
২. ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ, ভারসাম্যহীনতা, সামঞ্জস্যহীনতা ও অস্থিরতা নির্ধারণ ও পরিমাপ করা;
৩. ব্যক্তির সমস্যা সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব ও হতাশার পরিমাপ নির্ণয় করা।
৪. ব্যক্তির প্রত্যাশার পরিমাপ নির্ণয় করা।
৫. ব্যক্তির সামর্থ্য, ক্ষমতা, বিচারবোধ, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার মূল্যায়ন করা;
৬. সমস্যা মোকাবিলায় ব্যক্তি নিজে কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে তা বিবেচনায় আনা এবং
৭. সমস্যা মোকাবিলায় ব্যক্তি কি ধরনের ভূমিকা পালন করছে বা করতে চায়।
Marry Richmond সর্বপ্রথম সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় ধারণাটি উদ্ভাবন করেন। ১৯৭১ সালে তাঁর ‘Social Diagnosis’ গ্রন্থ প্রকাশিত হলে এ ধারণাটি বিস্তার লাভ করতে থাকে।
সাধারণভাবে বলা যায়, ব্যক্তির সমস্যা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষা করে তার সমস্যা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গহণকে বলা হয় সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়। এটা একটি মানসিক প্রক্রিয়া।এর মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তি ও তার সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্ন দিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় এবং সমস্যা ও তার প্রকৃতি সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায়।অন্যভাবে বলা যায়, সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় বলতে ব্যক্তি ও তার সমস্যার যাবতীয় তথ্য এবং প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদান করা সম্ভব এমন ধরনের সাহায্য সংক্রান্ত কর্মপ্রচেষ্টার একটি সুষ্ঠু নকশা বা পরিকল্পনাকে বুঝানো হয়।
The Dictionary of Social Welfare এর সংজ্ঞানুযায়ী, “সাহায্যার্থী ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও সমস্যার সাথে জড়িত।সঠিক ও প্রকৃত সংজ্ঞা জানার প্রচেষ্টা হচ্ছে সমস্যা নির্ণয়।”
ড. আব্দুল হাকিম সরকার বলেন, “সমাজকর্ম প্রক্রিয়ায় আভিধানিক অর্থে সমস্যার স্বরূপ নির্ণয় হচ্ছে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তি বা সাহায্যার্থীর ব্যক্তিত্ব ও তার মনোসামাজিক অবস্থা বা সমস্যার সঠিক সংজ্ঞায় পৌছার এক নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস। এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে হলে এরূপ বলা যায় যে, এটা এক সচেতন মানসিক কর্মপ্রয়াস যাতে সাহায্যার্থী ব্যক্তির সার্বিক ধারণা, স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান, আন্দাজ, অন্তর্দৃষ্টি ও তার অসম্পূর্ণ চিন্তাভাবনা ইত্যাদি অত্যন্ত শৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে তার সমস্যার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।”
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যানুযায়ী, “সমস্যা নির্ণয় হলো এমন এক ধরনের প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যার প্রকৃতি, কারণ, বিবর্তন ও পূর্বাভাস নির্ধারণ করা হয়; সমস্যার সাথে জড়িত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও অবস্থা নির্ণয় করা যায়।
সমস্যা, উপলব্ধি ও মোকাবিলায় সমাজকর্মের ভূমিকা এবং কিভাবে সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তা নির্ধারণ করাও এ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত।
সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ের ধরন বা প্রকারভেদ : ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা নির্ণয় তিন ধরনের হয়ে থাকে।
নিম্নে এগুলো আলোকপাত করা হলো :
১. গতিশীল সমস্যা নির্ণয় : সাহায্যার্থীর সমস্যার পিছনে যেসব কারণ রয়েছে সেগুলো খুঁজে বের করা গতিশীল সমস্যা নির্ণয়ের লক্ষ্য। অর্থাৎ সমস্যাকে ঘিরে যেসব দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে, সাহায্যার্থীর কল্যাণের
পথে বাধা সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ, সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্যার্থী, সংস্থা, সমষ্টিতে কী ধরনের সম্পদ ও সামর্থ্য রয়েছে এসব কিছু নির্ণয় গতিশীল ডায়াগনসিসের কাজ।
এইচ.এইচ. পার্লম্যান এর মতে “এটি হচ্ছে ব্যক্তির সমস্যার সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন উপকরণ বা শক্তির আন্তপ্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক নির্ণয়ের উপায়। যেসব শক্তিসমূহ ব্যক্তির নিজের ও তার সামাজিক পরিবেশে এবং ব্যক্তি ও তার পরিবেশের মধ্যে ক্রিয়াশীল।” এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রধানত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উদঘাটনের প্রচেষ্টা চালানো হয়।
ক. সাহায্যার্থীর অসুবিধা কি? কী কী মনোদৈহিক এবং সামাজিক উপকরণ সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী?
খ.ব্যক্তি এবং অন্যান্যের কল্যাণে সমস্যার প্রতিকূল প্রভাব কী?
গ. সমস্যার সমাধান সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি কী এবং ব্যক্তি তার সমস্যার কিরূপ সমাধান প্রত্যাশা করে?
ঘ. সমস্যা সমাধানে সাহায্যার্থী কর্তৃক গৃহীত প্রচেষ্টা এবং তার প্রভাব।
ঙ. সাহায্যার্থীর প্রত্যাশিত সমাধানের সাথে এজেন্সির সাহায্যের সামঞ্জস্যতা ও সম্পর্ক যাচাই করে দেখা।
২. চিকিৎসাজনিত সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়া : সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ের এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্যার ধরন বা অসুবিধার প্রকৃতি অনুযায়ী ব্যক্তির শ্রেণিবিন্যাস করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এটি মূলত মানসিক রোগীদের সমস্যার কারণ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।ব্যক্তিত্বের অসংগতি, আচরণের ত্রুটি, অসামঞ্জস্যতা, সাহায্যার্থীর প্রত্যাশা, প্রয়োজন ও ভূমিকা পালনের ত্রুটির কারণ নির্ণয়ে এ পদ্ধতি ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এইচ. এইচ. পার্লম্যান এর মতে “এ প্রক্রিয়ার সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের গুণাগুণ ও নির্দিষ্ট ধরন, সামঞ্জস্য বিধানে সমস্যা এবং নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের অন্তরায় সৃষ্টিকারী চাহিদা বা আচরণের ধরন শনাক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। ব্যক্তি সমাজকর্মে সমস্যা নির্ণয়ে আংশিক প্রক্রিয়া হিসাবে এটি বিবেচিত।”
৩. ঐতিহাসিক বা উৎপত্তিগত সমস্যা নির্ণয় প্রক্রিয়া : এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক বা অব্যবহিত কারণ নির্ণয়ের প্রচেষ্টা না চালিয়ে সমস্যার প্রবণতা সৃষ্টিকারী বা সমস্যার উৎপত্তিগত কারণ নির্ণয়ের প্রয়াস চালানো হয়। এতে সমস্যার কারণ ও ক্রমবিকাশের ধরন নির্ণয় করা হয়। সমস্যার উৎপত্তিগত ইতিহাস উদ্ঘাটন এ প্রক্রিয়ার বিবেচ্য বিষয়। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির ভূমিকা এবং ব্যক্তিত্বের মধ্যে নিহিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা চালানোই এ প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য। বিশেষ সাহায্যর্থীর সমস্যার বর্তমান কারণের চেয়ে অতীত কারণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
H.H. Pariman 43 “The effort to ascertain the birth of problem and its cause effect development is called an etiological or genetic diagnosis” অর্থাৎ, একটি সমস্যার উদ্ভব, উত্তরণ এবং এর কার্যকারণ ও বিকাশের কারণ নিশ্চিতের যে প্রচেষ্টা তাকে সমস্যার উৎপত্তি সংক্রান্ত সমস্যা নির্ণয় বলা হয়।
ব্যক্তি সমাজকর্মের সমস্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত ৩ ধরনের সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ের প্রক্রিয়ারই প্রয়োজন পড়ে।উক্ত ৩ প্রক্রিয়া পৃথক সত্তায় প্রতিষ্ঠিত হলেও অনুশীলন বা বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে এদের প্রকারগত ভেদাভেদ রক্ষা করা যায় না। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তিনটি প্রক্রিয়াই ব্যবহার করতে হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সমস্যার স্বরূপ নির্ণয়ের প্রক্রিয়া সাহায্যথীর সাথে প্রথম সাক্ষাৎকার থেকে শুরু করে সমস্যা সমাধানের শেষ দিন পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। সময়ের আবর্তনে মক্কেল ও তার সমস্যা সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য উদঘাটিত হয় এবং সেই সাথে ডায়াগনসিসও পরিবর্তিত হয়। উত্তম ডায়াগনসিস পর্যাপ্ত ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর নির্ভরশীল।