অথবা, সমসাময়িক মুসলিম দর্শনে ইকবালের প্রভাব কতটুকু? তা আলোচনা কর।
অথবা, সমসাময়িক মুসলিম দর্শনে ইকবালের অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, সমসাময়িক মুসলিম দর্শনে ইকবালের অবদান ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে আল্লামা ইকবাল বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। তিনি মুসলিম দর্শনে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক ও পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি পাশ্চত্যের সেসব দিক গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন, যেগুলো ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থি ছিল না। ইসলামি শিক্ষার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা পুনর্জাগরণে তার অবদান
অপরিসীম। তাই অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন আল-গাজালির পর যদি এমন কোন চিন্তাবিদ থেকে থাকেন যিনি মুসলিম দর্শনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি হলেন আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল।
সমসাময়িক দর্শনে ইকবালের অবদান : আধুনিক মুসলিম জগতে ইকবাল যে, সর্বাপেক্ষা প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি দার্শনিক ও কবি হিসেবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুধী সমাজে যথেষ্ট পরিচিতি ও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। তিনি সমসাময়িক মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হন এবং মুসলিম সামাজের পুনর্জাগরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি এটা দেখাতে সক্ষম হন যে, ইসলাম নিছক অনুভূতি বা বিশ্বাসের ধর্ম নয়, বরং এটি পরিপূর্ণ মানব জীবন বা Complete code of lif বলা যেতে পারে। ইসলাম সমগ্র
মানব সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের চিত্রাদর্শন ও আদর্শ কর্মসূচি মূলত ইসলামে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।
ইসলামের পুনর্জাগরণ : ইসলামের পুনর্জাগরণে ইকবালের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বলেছেন, আমাদের বা মুসলমানদের দু’টি দিকের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। ১. কুসংস্কার পরিহার ২. অহংকে জাগ্রত
করা। তিনি বলেছেন, কুসংস্কার আমাদেরকে পশ্চাৎপদ করে রাখে এবং এটি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সর্বদা বাধা প্রদান করে। অন্যদিকে, অহং (বা যাকে তিনি খুদী বলে অবিহিত করেন) আমাদেরকে সত্যের পথে পরিচালিত করে সফলতা দান করে। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণকে নিরুৎসাহিতকরণ : ইকবাল পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পাশ্চাত্যে জড়বাদ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদের জীবনে আনে বৈষম্য। অপরদিকে, প্রাচ্যের জীবনবিমুখ ও কর্মবিমুখ লোক দেখানো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিরও কঠোর সমালোচনা করেন। তার মতে, পাশ্চাত্যের আত্মাবিহীন নির্জলা পুঁজিবাদ ও জড়বাদ এবং প্রাচ্যের
কর্মবিহীন নিশ্চল অধ্যাত্যবাদ নয়, বরং এ দু’য়ের মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয় সাধনের মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো কর্মবিমুখতার বিরোধিতা করা।
ইসলামি শিক্ষার প্রতি উদাত্ত আহ্বান : ইসলামি চিন্তাচেতনার মাধ্যমেই ইকবালের নিজস্ব চিন্তা কাঠামো গড়ে উঠেছে। তাঁর মতে, নিজ ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ মানবজীবনের প্রধান লক্ষ্য। ব্যক্তি সত্তার বিকাশ ঘটানোর শক্তি মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা তাকে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ ঘটাতে সাহায্যে করে। মানুষ ভাগ্য দ্বারা নয়, বরং কর্ম দ্বারা
তার অবস্থাকে তৈরি করতে পারে।
ধর্মীয় চিন্তা সংস্কার ও পুনর্গঠন : ইকবালের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ইহজাগতিক ও পারলৌকিক উন্নতি সাধন। আর এজন্য প্রয়োজন ছিল ইসলামি ধর্মীয় চেতনার সংস্কার ও পুণর্গঠন। এ লক্ষে তিনি একটি বই লেখেন, সেটি হলো The Reconstruction of Religious thought in Islam. এ বইয়ে তিনি ধর্মীয় ভাবধারার
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। তার এ মত মুসলিম ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাকে
বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিল। তিনি মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ ও সার্থক রূপায়নের জন্য ইহকাল ও পরকাল এ উভয় দিকের উপর গুরুত্
ব আরোপ করেন। তিনি বলেছেন, মুসলমানদিগকে শুধু ইহকালকে অবজ্ঞা করে পারলৌকিক সুখ শান্তির কথা চিন্তা করলেই চলবে না, বরং কঠোর সাধনার মাধ্যমে জাগতিক জীবনকে অর্থবহ করতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, জাগতিক মোহে যেন তারা না পড়ে যায়। তিনি মুসলমানদের এমন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেন, যেখানেএকদিকে যেমন ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের জন্য প্রতিটি মানুষে ব্যক্তিসত্তার বিকাশের পূর্ণ স্বাধী নতা থাকবে। অন্যদিকে সে সমাজে থাকবে না কোন শোষণ। তিনি ইসলামি সাম্য, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সমগ্র
মানবজাতির কল্যাণে নিয়োজিত থাকতে মুসলমানদের আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, ইসলামের মূল শিক্ষা উপলব্ধি এবং তার কার্যকারী বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সমগ্র বিশ্বে শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি জাতীয় ও ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন। তবে বিশ্বজাতীয়তাবোধের কথাও বলেছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তার মতবাদে উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে।
প্রগতিবাদী চিন্তাধারা : ইকবাল ছিলেন একজন প্রগতিবাদী চিন্তাধারার অন্তর্গত দার্শনিক ও সংস্কারক। কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার উপর তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। তবে তিনি গোঁড়া ও রক্ষণশীল মতাদর্শের সমর্থন করেন নি, বরং বলা যায় যে, একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সমাজতন্ত্রের সমর্থক। তাঁর মতে, পুঁজিবাদ অথবা সাম্রাজ্যবাদ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশার মূল কারণ তিনি ইসলামের সাথে সমাজতন্ত্রের সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনীয়তার
কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেছেন, ইসলামে সামাজ্যবাদের যে রূপ প্রকাশিত হয়েছে তার বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব মানব জীবনে সফলতা ও মুক্তি। তাই আমরা বলতে পারি যে, ইসলামি চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ইকবালের বিপ্লবাত্মক মতাদর্শ যে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলে তা অনস্বীকার্য।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আল্লামা ইকবাল তাঁর দর্শনে মুসলমান জাতির হারানো অতীত, ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে বর্তমান হতোদ্যম পশ্চাৎপদ মুসলমানদের প্রতি নবজাগরণের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি খুদীকে জানার ও উন্নতকরণের উপর জোর দেন এবং কুসংস্কার পরিহার করতে অনুপ্রাণিত করেন। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ না করে বরং ইসলামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়াদি গ্রহণের কথা বলেন। তিনি ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনাকে যুগোপযোগী করতে সংস্কার ও পুনর্গঠনের চেষ্টা করেন। ইসলামি চিন্তাধারা এবং জীবনযাপনে ইকবালের অবদান অনস্বীকার্য।