অথবা, সমষ্টি সংগঠন বলতে কি বুঝ? সমষ্টি সংগঠনের প্রক্রিয়া বর্ণনা কর।
অথবা, সমষ্টি সংগঠন কাকে বলে? সমষ্টি সংগঠনের পর্যয়সমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, সমষ্টি সংগঠন কী? সমষ্টি সংগঠনের ধাপসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : সমষ্টি সংগঠন আধুনিক সমাজকর্মের একটি মৌলিক পদ্ধতি। সমষ্টি সংগঠন হল এমন একটি দলীয় প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে কোন সমষ্টির সমস্যাসমূহ এবং ঐ সমষ্টির কি কি সম্পদ আছে তা খুঁজে বের করা হয়। এরপর ঐ সমস্যা ও সম্পদের মাঝে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত সমষ্টিকে এমনভাবে সহায়তা করা হয়, যাতে করে সমষ্টির জনগণ নিজেরাই নিজেদের সমস্যা মোকাবিলায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। তবে সমষ্টি সংগঠন কর্মীকে ধাপে ধাপে এসব সহায়তা করতে দেখা যায়।
সমষ্টি সংগঠন : সমাজকর্মের যে মৌলিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোন সমষ্টির সমস্যাবলি চিহ্নিত করে তা মোকাবিলা করার জন্য ঐ সমষ্টিকে সাথে নিয়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাকে সমষ্টি সংগঠন বলে।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : সমষ্টি সংগঠন সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নিম্নে তাঁদের প্রদত্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হল ঃ
TIPT)
সমাজবিজ্ঞানী Marry G. Ross সমষ্টি সংগঠন সম্পর্কে তাঁর ‘Community Organization Theory and Practice’, “Community organization is a process by which a community identifies its needs or objectives, orders (or ranks) these needs or objectives, develops the confidence and will to work all needs or objectives, finds the resources (internal and external) to deal with these needs
or objectives, takes action in respect to them co-operative and collaborative attitudes and practices in the community.” অর্থাৎ, সমষ্টি সংগঠন এমন একটি প্রক্রিয়া, যা সমষ্টির প্রয়োজন বা লক্ষ্যসমূহ চিহ্নিত, প্রয়োজন বা লক্ষ্যসমূহকে অগ্রাধিকার প্রদান, সেসব প্রয়োজন বা লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার ইচ্ছা ও বিশ্বাস সৃষ্টি সম্ভাব্য সম্পদ (আন্তঃ ও বহিঃ) খুঁজে বের করে ও প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা গ্রহণ করে এবং এসব করতে গিয়ে সমষ্টিতে সামরিক ও সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুশীলনের প্রসার সাধন করে।
W. A. Friedlander সমষ্টি সংগঠনের সংজ্ঞায় বলেছেন, “সমষ্টি সংগঠন এমন একটি সমাজকর্ম পদ্ধতি, যার মাধ্যমে কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকার সমাজকল্যাণমূলক প্রয়োজন ও সম্পদের মধ্যে ফলপ্রসূ সামঞ্জস্য বিধান করা হয়।”
Aurthun Dunham সমষ্টি সংগঠনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “Community organization is the process of bringing about maintaining adjustment between social welfare needs and social
welfare resources in geographical or a special field of service.” অর্থাৎ, সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে সমষ্টি সংগঠন হচ্ছে সমাজসেবার কোন বিশেষ ক্ষেত্র অথবা কোন ভৌগোলিক এলাকার সমাজকল্যাণের প্রয়োজনসমূহ ও সমাজকল্যাণ সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রক্রিয়া বিশেষ ।
C. F. McNail সমষ্টি সংগঠনের সংজ্ঞায় বলেছেন, “সমষ্টি সংগঠন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া বিশেষ, যার মাধ্যমে সমষ্টির সদস্যগণ ব্যক্তিগতভাবে অথবা দলের প্রতিনিধি হিসেবে একত্র হয়ে সমাজকল্যাণে চাহিদা নির্ণয়, চাহিদা, পূরণের উপায় সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালায়।”
Carten সমষ্টি সংগঠনের সংজ্ঞায় বলেছেন, “The practices of community organization involves- a. Social work intervention in a given situation which. b. Initiates or guides. c. A movement
or change process toward, d. A goal.”
সুতরাং উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায় যে, সমষ্টি সংগঠন এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে সমষ্টির প্রয়োজন ও চাহিদাসমূহ খুঁজে বের করে সে প্রয়োজন ও সম্পদের মাঝে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সমষ্টির সমস্যা মোকাবিলা করে থাকে।
সমষ্টি সংগঠনের স্তরসমূহ : সমষ্টি সংগঠন কর্মীকে সমষ্টির সমস্যা মোকাবিলায় কতকগুলো ধাপ বা স্তর অতিক্রম করতে হয়। নিম্নে সে ধাপগুলো আলোচনা করা হল :
সমাজবিজ্ঞানী Aurthur Dunham সমষ্টি সংগঠনের নয়টি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে পর্যায়ক্রমে ও ধাপগুলো আলোচনা করা হল :
১. সমস্যা ও প্রয়োজনের স্বীকৃতি : সমষ্টি সংগঠনের প্রথম ধাপ হল সমস্যা ও প্রয়োজনের স্বীকৃতি। সমষ্টি সংগঠন কর্মীকে প্রথমেই খ
ুঁজে বের করতে হবে ঐ সমষ্টির কি কি সমস্যা ও প্রয়োজন রয়েছে। কারণ সমস্যা ও প্রয়োজনসমূহ চিহ্নিত না হলে সমষ্টি সংগঠন পদ্ধতি প্রয়োগ করা যাবে না।
২. ‘সমস্যা বিশ্লেষণ : সমষ্টি সংগঠনের দ্বিতীয় ধাপ হল সমস্যা বিশ্লেষণ। সমস্যা ও প্রয়োজনসমূহ খুঁজে বের করার পর দেখতে হবে আসলে ঐ সমস্যা সমষ্টির জনগণের উপর কতটুকু প্রভাব ফেলছে এবং এটা সমাধান করাটা জরুরি কি না।
৩. তথ্য সংগ্রহ : সমষ্টি সংগঠনের তৃতীয় ধাপ হল তথ্য সংগ্রহ। সমস্যা ও প্রয়োজনসমূহ খুঁজে বের ও বিশ্লেষণ করার পর ঐ সমস্যা এবং এর সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জরিপ করা যেতে পারে।
৪. পরিকল্পনা প্রণয়ন : যে কোন কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা করতে হয়। কারণ পরিকল্পনা ছাড়া কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যায় না। সমষ্টি সংগঠনের সমস্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সঠিক ও কার্যকরী পরিকল্পনা থাকা জরুরি। এ পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে কোন কোন সমস্যা সমাধান করা হবে, কিভাবে করা হবে, সমস্যা কোথা হতে আসবে, জনগণের অংশগ্রহণ কিভাবে করা হবে, এতে জনগণ কতটুকু সুবিধা পাবে ইত্যাদি।
৫. অনুমোদন : সমষ্টি সংগঠন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে তা যথাযথ যাচাই বাছাই ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে হবে। এরপর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা অনুমোদন করে নিতে হবে। এখানে কোন অংশ প্রয়োজনে বাদ দেওয়া যেতে পারে। আবার প্রয়োজনে নতুন কোন বিষয় সংযোজন করা যেতে পারে।
৬. বাস্তবায়ন : সমষ্টি সংগঠনের এ ধাপটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি সমষ্টির সমস্যাবলি সমাধানের জন্য যেসব কর্মসূচি ও পরিকল্পনা নেওয়া হয় তা এ পর্যায়ে এসে বাস্তবায়ন হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নই প্রমাণ করে পরিকল্পনা সঠিক না ভুল ছিল।
৭. রেকর্ডিং ও প্রতিবেদন প্রণয়ন : সমষ্টি সংগঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল রেকর্ডিং ও প্রতিবেদন প্রণয়ন । সমষ্টি সংগঠনের ক্ষেত্রে যেসব কাজ করা হয় তা রেকর্ড আকারে জমা করে তা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হয় এ স্তরে।
৮. সামঞ্জস্য বিধান : সমষ্টি সংগঠনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল সামঞ্জস্য বিধান। সমস্যা ও সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান অন্যতম। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, সে অনুযায়ী বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। অর্থাৎ পরিকল্পনার সাথে বাস্তবে কোন ক্ষেত্রে অসংগতি দেখা দিলে এ স্তরে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করা হয়।
সমাজবিজ্ঞানী Edward C. Lindeman তাঁর The Community an Introduction to the Study of Community Leadership and Organization’ গ্রন্থে সমষ্টি সংগঠনের ১০টি ধাপের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে
এগুলো আলোচনা করা হল :
১. সমষ্টির প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতনতা : সমষ্টি সংগঠনের প্রথম ধাপ হিসেবে Lindeman বলেছেন, প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন করা, সমাজের মানুষ অনেক সময় অসচেতন থাকে। তারা সমাজ নিয়ে চিন্তা করে না। ফলে তাদের কি কি সমস্যা ও চাহিদা আছে সে সম্পর্কে তারা অবগত নয়। সুতরাং সমষ্টি সংগঠনের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমষ্টির
সমস্যা ও চাহিদা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা।
২. প্রয়োজন সম্পর্কে সমষ্টির সবাইকে সচেতন করে তোলা : সমষ্টি সংগঠনের দ্বিতীয় ধাপ বা স্তর হল প্রয়োজন সম্পর্কে সমষ্টির সবাইকে সচেতন করে তোলা। সমষ্টির কি সমস্যা ও প্রয়োজন রয়েছে তা সমষ্টির জনগণকে বুঝাতে হবে এবং এ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।
সচেতন হলেই চলবে না, বরং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখাতে হবে যে, আসলেই তারা এ সম্পর্কে
৩. প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতনতার প্রতিফলন : সমষ্টির কি কি চাহিদা ও প্রয়োজন রয়েছে সে সম্পর্কে জনগণ সচেতন। যাতে বুঝা যায় সমষ্টির জনগণ তাদের সমস্যাবলি দূর করতে আগ্রহী।
৪. সমস্যা সমাধানে জনগণের মানসিক প্রস্তুতি : সমষ্টি সংগঠনের এ
স্তরে সমষ্টির জনগণকে সমস্যা সমাধানে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। অর্থাৎ সমষ্টির জনগণ বুঝাতে সক্ষম হবেন যে, তাদের সমস্যাবলি তারা সমাধান করতে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এর জন্য সব রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে তারা বদ্ধপরিকর।
৫. সমস্যার বিকল্প সমাধান : সমষ্টি সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল সমস্যার বিকল্প সমাধান। সমষ্টি সংগঠনের জন্য যখন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে তখন এর বিকল্প সমাধানের বিষয়ে সবার সাথে আলাপ করে রাখতে হবে
যাতে প্রয়োজনে বিকল্প উপায়েও এটা সমাধান করা যায়।
৬. সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে ঐকমত্য সৃষ্টি : সমষ্টি সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি। কারণ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সমষ্টির জনগণের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলে সে
সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে না।
৭. অনুসন্ধান : সমষ্টি সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল অনুসন্ধান। এ স্তরে সাধারণত বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
৮. সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে আলোচনা : সমষ্টি সংগঠনের এ ধাপে সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করা হবে। এ আলোচনায় সবাই অংশগ্রহণ এবং তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারবে। তবে সবার মতামতই সমষ্টি সংগঠন কর্মীকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
৯. সমাধানমূলক প্রস্তাবসমূহের পর্যালোচনা : সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে যেখানে খোলামেলা আলোচনা করা হবে, সেখানে বিভিন্ন জনসমস্যা সমাধানমূলক প্রস্তাব পেশ করবে। এ পর্যায়ে ঐ সকল প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনা ও যাচাই বাছাই করা হবে।
১০. সাময়িক উন্নতির ভিত্তিতে আপসমূলক ব্যবস্থা : সমষ্টি সংগঠনের এ ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমস্যা সমাধানের জন্য যেসব পেশ করা হয়েছিল তা পর্যালোচনা ও যাচাই বাছাই করে যেগুলো গ্রহণ করা যায় তা গ্রহণ এবং যেগুলো বর্জন করতে হবে তা বর্জন করা হয়। এরপর গৃহীত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমষ্টি সংগঠন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা হতে একথা বলা যায় যে; সমষ্টি সংগঠন সমষ্টির সমস্যা ও সম্পদ চিহ্নিত করে সমস্যা ও সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত সমষ্টিকে এমনভাবে সহায়তা করে থাকে যাতে ঐ সমষ্টি তাদের নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। এসব কাজ কতিপয় সুনির্দিষ্ট ধাপ বা স্তরের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয় ।