অথবা, সমষ্টি উন্নয়নের দার্শনিক ভিত্তি আলোচনা কর।
অথবা, সমষ্টি উন্নয়নের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর।
অথবা, সমষ্টি উন্নয়নের দর্শন আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমষ্টি উন্নয়ন সারা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে পরিচিত। সমষ্টি উন্নয়ন সমাজকর্মের একটি মৌলিক পদ্ধতি। সমাজকর্মের মৌলিক পদ্ধতি হিসেবে সমষ্টি উন্নয়ন কোন এলাকার জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য উন্নয়নে সহায়তা করে। সমষ্টি উন্নয়ন হল সরকার ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা। এর মাধ্যমে সরকারি সম্পদের পাশাপাশি জনগণের সম্পদও কাজে লাগানো হয়। সমষ্টি উন্নয়ন বর্তমানে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও প্রাচীনকাল থেকেই সমষ্টি উন্নয়নের ধারা চলে আসছে। অন্যদিকে, সমষ্টি উন্নয়নের
রয়েছে সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তি। ফলে সমষ্টি উন্নয়ন সমষ্টি জনগণের সমস্যা সমাধানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সমষ্টি উন্নয়নের ক্রমবিবর্তন বা ইতিহাস বা ক্রমবিকাশ : সমষ্টি উন্নয়ন বর্তমানে যে অবস্থায় এসেছে সে অবস্থায় কখনও ছিল না। সমষ্টি উন্নয়নের আজকের এ অবস্থানে আসতে বেশ সময় লেগেছে। সমষ্টি উন্নয়নের ইতিহাস মানব ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। মানবসভ্যতা বিবর্তনের মাধ্যমে যেমন বর্তমান অবস্থায় পৌঁছে তেমনি সমষ্টি উন্নয়নও
বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। মানবসভ্যতার শুরুতে কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করত না। তারা বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। পাহাড়ের গুহায় বা বড় গাছের ডালে বাস করত। তখন মানুষ বনের পশুপাখি শিকার করে খেত। বনজঙ্গলের ফলমূল সংগ্রহ করে খেত। এরপর মানুষ পশুপালন করতে শিখল। নদীর তীরে যেখানে পানি পাওয়া যেত সেখানে বসবাস শুরু করল, কৃষিকাজ আয়ত্ত করল। আস্তে আস্তে মানুষ সমাজ ও সম্প্রদায় গড়ে তুলল। এসব সমস্যা
সমাধানের প্রচেষ্টাও তখন থেকেই শুরু। সমষ্টি উন্নয়নের যাত্রা তখন থেকেই শুরু হয় বলে অনেকে মনে করেন। তবে আধুনিক সমষ্টি উন্নয়নের সূচনা হয় ১৯৪৯ সালে। ১৯৪৯ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ইনস্টিটিউট সর্বপ্রথম সমষ্টি উন্নয়ন ক্লিয়ারিং হাউস প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ১৯৫২ সালে জাতিসংঘ সমষ্টি উন্নয়ন গ্রুপ গঠন করে। জাতিসংঘের এ
প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় সমষ্টি উন্নয়নের সভা, সমিতি, সেমিনার আয়োজন করা হয় এবং সারা বিশ্বব্যাপী সমষ্টি উন্নয়ন প্রসারতা লাভ করে। এরপর ১৯৫৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিষদ সমষ্টি উন্নয়নকে পল্লিউন্নয়নের মডেল হিসেবে ঘোষণা করে। তখন থেকেই জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সমষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক পরিষদ তাদের কর্মসূচির নাম দেয় সমষ্টি উন্নয়ন কর্ম
এ কর্মসূচির সাথে জাতিসংঘের নিম্নোক্ত প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে :
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমিশন।
ফোর্ড ফাউন্ডেশন। এশিয়া ফাউন্ডেশন। নিকট প্রাচ্য ফাউন্ডেশন। সেভ দি চিলড্রেন ফেডারেশন। আমেরিকার ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি ইত্যাদি। এরপর ইউনেস্কো সমষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের সহায়তা করে। ইউনেস্কো বয়স্ক শিক্ষা বাস্তবায়নে সমষ্টি উন্নয়নের আশ্রয় নেয়। সেজন্য তারা অনেক দেশে বিশেষজ্ঞ প্রেরণ করে। ১৯৫৪ সালে আমেরিকায় সমষ্টি উন্নয়ন বিভাগ খোলা হয়। এ বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বিশেষজ্ঞ প্রেরণ, আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য প্রদান করে। এভাবে সমষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সমষ্টি উন্নয়ন সারাবিশ্বে সমষ্টি জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম।
সমষ্টি উন্নয়নের দার্শনিক ভিত্তি : সমষ্টি উন্নয়নের কতিপয় দর্শন রয়েছে। এসব দর্শনের উপর ভিত্তি
করেই সমষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সমষ্টি উন্নয়ন ও পরিকল্পনাবিদগণ এ দর্শনসমূহ মেনে চলেন। আমেরিকান Wealth and Welfare Planning for Community Chests and Councils Special Advisory Committee সমষ্টি উন্নয়নের নিম্নোক্ত দর্শনের কথা বলেছে :
৩. সমষ্টি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সমষ্টির এবং ব্যক্তির সারাজীবনের কল্যাণের সাথে জড়িত। ফলে সমষ্টি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় রাখে। সমাজ সদা পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে সেবাদানের ব্যবস্থা করে সমষ্টি পরিকল্পনা।
তাছাড়া সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যা কিভাবে সমাধান করে মানবকল্যাণ সাধন করা যাবে তার
ব্যবস্থা করে সমষ্টি উন্নয়ন। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিরই রয়েছে সমস্যা সমাধানের নিজস্ব ক্ষমতা। কিন্তু মানুষ পরস্পর নির্ভরশীল। তাছাড়া এমন কিছু সমস্যা মানবজীবনে আসে, যা মানুষ একা একা সমাধান করতে পারে না। আবার সমাজে একজনের কল্যাণ
অনেককে প্রভাবিত করে। ফলে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে মানুষকে পারস্পরিক কল্যাণে একসাথে কাজ করতে হয়। সমষ্টি পরিকল্পনা ও উন্নয়ন তখনই নেওয়া হবে যখন সমষ্টির সব জনগণের সমস্যা ও চাহিদা হতে এর প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হবে। ফলে সমষ্টির সর্বস্তরের জনগণই এতে অংশগ্রহণের অধিকার রাখে। সমষ্টি উন্নয়নে অংশ নেওয়া তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে । সমষ্টি উন্নয়নের অন্যতম দর্শন হল এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সমষ্টি উন্নয়নের প্রতিটি পর্যায়ে ব্যক্তি, সংস্থা ও সংগঠনের সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের মতামত ও পরামর্শ দান করে থাকে। সমষ্টি উন্নয়নে জনগণ গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ায় তাদের প্রতিনিধিও প্রেরণ করতে পারে
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা হতে একথা বলা যায় যে, সমষ্টি উন্নয়ন হল সমষ্টি জনগণের আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে তাদের ভাগ্যোন্নয়নের একটি কার্যকর ব্যবস্থা। সারা বিশ্বব্যাপী পল্লিউন্নয়নে সমষ্টি উন্নয়ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। সমষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রম প্রাচীনকাল হতে শুরু হলেও বর্তমানে সংগঠিত রূপ লাভ করেছে। সমষ্টি উন্নয়ন
কার্যক্রমের যেসব দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে তা সমষ্টি পরিকল্পনাবিদগণ মেনে চলতে বাধ্য।