উৎস : ব্যাখ্যেয় অংশটুকু বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচক প্রমথ চৌধুরী বিরচিত ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে
প্রসঙ্গ : সংস্কৃত সাহিত্যের সূত্র ধরে যৌবনের ও বার্ধক্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক এ মন্তব্যটি করেছেন।
বিশ্লেষণ : সংস্কৃত সাহিত্যকে বলা হয় যৌবনের সাহিত্য। যুবক-যুবতী ছাড়া সে সাহিত্য-রাজ্যে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। তবে যে যৌবনের স্বরূপ তাতে চিত্রিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে ভোগবাদী। ভোগের চিত্র ছাড়া তাই সংস্কৃত কাব্য বা নাটকে অন্য কোন ছবি খুঁজে পাওয়া যায় না। কৌশাম্বির যুবরাজ উদয়ন আর কপিলাবস্তুর যুবরাজ সিদ্ধার্থ উভয়ে ছিলেন রূপে, গুণে ও শক্তিতে অনন্য এবং সমসাময়িক। তবে তাদের জীবনের দর্শন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। উদয়ন যেখানে ছিলেন ভোগের অবতার, সিদ্ধার্থ সেখানে ছিলেন ত্যাগের পূর্ণ অবতার। উদয়নের জীবনের ব্রত ছিল ভোগের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া। পক্ষান্তরে সিদ্ধার্থের জীবনের ব্রত ছিল মানুষের ভোগাকাঙ্ক্ষা ও মোহ নাশ করে তাকে সংসারের সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা। সংস্কৃত সাহিত্যিকগণ সমসাময়িক এ দুই যুবরাজের মধ্যে উদয়নের জীবন ব্রতকেই যৌবনের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে তাঁর গুণগানে মুখর হয়েছেন। ফলে উদয়নের কথা অধিকার করেছে সংস্কৃত সাহিত্যের অধিকাংশ স্থান। পক্ষান্তরে বুদ্ধ চরিতের কোন স্থান হয়নি সংস্কৃত সাহিত্যে। বুদ্ধ যেহেতু ত্যাগের বাণী শুনিয়েছেন সবাইকে, তাই যৌবনের পূজারী সংস্কৃত কবিগণ বুদ্ধের জীবনদর্শনকে তাদের কাব্যাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেননি। আর এখানেই সংস্কৃত কবিগণ যৌবনধর্মের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ সত্যকে উপেক্ষা করে গেছেন। তারা শুধু ভোগকেই যৌবনের ধর্ম ভেবেছেন, আর ত্যাগকে ভেবেছেন বার্ধক্যের ধর্ম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভোগের মত ত্যাগও যৌবনেরই ধর্ম। বার্ধক্য যেমন কিছু কাড়তে পারে না তেমনি ছাড়তেও পারে না। কিছু অর্জন করতে পারে না বলেই তা কিছু বর্জনও করতে পারে না। একমাত্র যৌবনই পারে অর্জনের ॥পাশি বর্জন করতে। তাই শুধু ভোগ নয়, ত্যাগও যৌবনেরই ধর্ম। অথচ সংস্কৃত কবিরা তা দুঃখজনকভাবে উপেক্ষা করে গেছেন।
মন্তব্য : সংস্কৃত কবিগণ ছিলেন একদেশদর্শী। তাই তাদের সাহিত্য হয়ে পড়েছিল পক্ষপাত দোষে দুষ্ট ।