অথবা, সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : যে কোনো সমাজব্যবস্থার অগ্রগতি ও কল্যাণের মূল হচ্ছে সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা। প্রত্যেক সমাজব্যবস্থায় সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা বিদ্যমান। সমাজব্যবস্থায় যে বৈচিত্র্য ও সমন্বয় তা সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতার মাধ্যমে গড়ে উঠে। সংস্কৃতি যেমন মানুষের জীবনপ্রণালিকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি ধর্ম মানুষের আত্মার মুক্তি দিয়ে থাকে ।
সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা : ভারতীয় উপমহাদেশের নানা নৃতাত্ত্বিক ও ভাষা গোষ্ঠীর মিলন ঘটেছে। ফলে মানুষের চেহারায় যেমন বৈচিত্র্য দেখা যায় তেমনি বৈচিত্র্য দেখা যায় ভাষার ক্ষেত্রে। মূলত ভারতবর্ষের মাটিতে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক এবং ভাষা গোষ্ঠীর লোকেদের মিশ্রণের ফলে যেসব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা। অন্যদিকে, ভারতবর্ষে যে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর পারস্পরিক সহনশীলতা তাকেই বলা হয় ধর্মীয় সহনশীলতা। নিচে সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা এবং ধর্মীয় সহনশীলতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা : সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা হলো বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে খাপখাইয়ে সাংঘর্ষিক পথে না যেয়ে
উভয়কে মেনে নিয়ে বসবাস করা। সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা দুইভাগে বিভক্ত; যথা :
১. সাংস্কৃতিক সাঙ্গীকরণ।
২. সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ ।
১. সাংস্কৃতিক সাঙ্গীকরণ : যখন একটি দল অন্য একটি দলের সান্নিধ্যে আসার পর ঐ দল থেকে সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ গ্রহণ করে নিজ দলের সাথে সঙ্গীকৃত করে নেয় এবং সেভাবে নিজ দলের সংস্কৃতিতে রূপান্তর ঘটায় তখন সাংস্কৃতিক সাঙ্গীকরণ সাধিত হয়। যদিও পরস্পরের সান্নিধ্যে আসা দলগুলো একে অন্যকে প্রভাবিত করার প্রয়াস পায় । তথাপি
অপেক্ষাকৃত উন্নত বা আধিপত্যশীল দলের সংস্কৃতির উপাদান বা নমুনাসমূহ অনুন্নত বা অধীন দল কর্তৃক গৃহীত হয়ে থাকে।
২. সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ : সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ অর্থাৎ সংস্কৃতির আত্তীকরণের প্রাথমিক স্তর। আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার এক সংস্কৃতি ব্যক্তিবর্গ অথবা দল বিশেষ অন্য সংস্কৃতির ব্যক্তিবর্গ বা দলের সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করে থাকে। এভাবে অন্য দলের নিয়মাচার, মূল্যবোধ, জীবনপ্রণালি গ্রহণ করে তারা সে দলের মধ্যে সম্পূর্ণ মিশে যায়। এভাবে ব্যক্তি বা দল কর্তৃক নিজস্ব সংস্কৃতিকে পরিহার করে সম্পূর্ণভাবে অন্য সংস্কৃতি গ্রহণ করাকে সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ বলে। এভাবে সংমিশ্রণ প্রক্রিয়ায় মিশ্র প্রজননের মাধ্যমে স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তিবর্গ ক্রমে একীভূত হয়ে যায়।
৩. ধর্মীয় সহনশীলতা : ধর্ম এবং সংস্কৃতি পারস্পরিক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ধর্ম যেমন সক্রিয়ভাবে সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে তেমনি সংস্কৃতি দ্বারাও ধর্ম প্রভাবিত হয়। ধর্মীয় সহনশীলতা হলো নিজ ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও অন্য ধর্মকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। বঙ্গদেশে এসে বহিরাগত সব ধর্মই
খানিকটা বঙ্গীয় চেহারা নিয়েছে। বঙ্গদেশের হিন্দু ধর্ম বঙ্গীয় হিন্দুধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম। হিন্দু ধর্মের আচারঅনুষ্ঠান এবং লোকাচারে ধর্মীয় প্রভাব দেখা যায়। ধর্মীয় উৎসবগুলো স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত, দেবদেবীতে রয়েছে পার্থক্য। ইসলাম ধর্মও বঙ্গদেশে এসে একটা বঙ্গীয় রূপ নিয়েছিল। প্রথমে সুন্নি ইসলামের তুলনায় সুফিবাদী ইসলামই বেশি জনপ্রিয় ছিল। সুফিবাদের সাথে স্থানীয় অদ্বৈতবাদ এর যোগের সমন্বয় ঘটেছিল। ইসলাম ধর্মে সংগীত ও যন্ত্রসংগীত নিষিদ্ধ হলেও গ্র
ামের বাঙালি মুসলমানরা সংগীতকে যথেষ্ট লালন করেছিল। এছাড়া বঙ্গদেশে সহজিয়া, নাথযোগী, বাউল, কর্তাভজা, সাহেব ধানী, মুরশিদি, মাইজভাণ্ডারি ইত্যাদি বহু ধর্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। প্রাচীন বাংলায় বৈদিক, পৌরাণিক, জৈন, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায় বর্তমান থাকলেও এদের মধ্যে কলহ ও হিংসা বিদ্বেষ ছিল না। এরা পরস্পর মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করত। পূর্ব বাংলায় ধর্মীয় স্বকীয়তার বদলে বাঙালি স্বকীয়তাকেই বড় করে দেখেছে, যা ধর্মীয় সহনশীলতা তথা ধর্মনিরপেক্ষ বলেও আখ্যায়িত করা যেতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গদেশের সংস্কৃতির মধ্যে যেমন আছে সমন্বয়বাদিতা তেমনি ধর্মীয় ক্ষেত্রে আছে সহনশীলতা। সংস্কৃতি মানবের জীবনপ্রণালি আর ধর্ম হলো পবিত্র বস্তুজগৎ সম্পর্কিত বিশ্বাস এর আচার-অনুষ্ঠানের এক সমন্বিত ব্যবস্থা। কাজেই সংস্কৃতির সমন্বয় এবং ধর্মীয় সহনশীলতা একটি সমাজব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য।