অথবা আদর্শ ও মূল্যবোধের আলোকে সংস্কৃতিকে আলোচনা কর ।
অথবা, সংস্কৃতির আদর্শ ও মূল্যবোধ কী? সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব আর এ সামাজিক জীবের অন্যতম বড় পরিচয় হলো তার সংস্কৃতি, যার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাপন সুন্দর, মার্জিত ও বৈচিত্র্যময় হয়। এ সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। তবে সমাজ, জাতি বা দেশভেদে সংস্কৃতির ধরন ও বৈশিষ্ট্যে স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত সমাজবদ্ধ মানুষের বিশিষ্ট পরিচয় হলো সংস্কৃতি। সে প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি সকল যুগে এবং সকল জায়গায় মানবসমাজেই স্বতন্ত্র সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া যায়। বস্তুত সংস্কৃতি হলো আমাদের সকল কর্ম, অর্থাৎ আমরা যা করি তাই সংস্কৃতি।
সাংস্কৃতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ : সাংস্কৃতিক আদর্শ বলতে বুঝায় কোন একটি দেশের বা সমাজের মানুষের কি ধরনের সংস্কৃতি রয়েছে এবং সে সংস্কৃতির আচার আচরণ, বিশ্বাস, লোককাহিনী, পোশাক পরিচ্ছদ প্রভৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য কোন দেশের সাংস্কৃতিক আদর্শ বা সাংস্কৃতিক নমুনা নির্ভর করে ঐ দেশের গোটা সমাজব্যবস্থার উপর। মোটকথা, সামাজিক আদর্শের মধ্যেই সমাজস্থ মানুষের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। কারণ সাংস্কৃতিক আদর্শের মধ্যেই বাসগৃহের নমুনা, তাদের চালচলন, পোশাক পরিচ্ছদের নমুনা, খাবারদাবারের রুচিবোধ প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে, বাংলাদেশের সংস্কৃতির নমুনা এবং পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির নমুনার তুলনাকে উল্লেখ করতে পারি। বস্তুত সাংস্কৃতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ বলতে আমরা কোন একটি অঞ্চলের বা সম্প্রদায়ের বিশেষ জীবন প্রণালীকে বুঝে থাকি যার মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের হুরের অধিবাসীদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য তাদের জীবন প্রণালী দ্বারা গড়ে উঠে। এ পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার সমাজস্থ মানুষ যখন নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সমাজ বিকাশলাভ করল তখন তাদের সামাজিক আদর্শ তুলনামূলকভাবে ভিন্ন ধরনের হয়ে উঠল। যার ফলে সকল সমাজই অভিন্ন আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠে নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবিজ্ঞানিগণ ভিন্ন ভিন্ন নমুনার সামাজিক মানুষের বিকাশ নির্ণয় করেছেন এবং এ বিভিন্ন ধরনের বিকাশকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আদর্শ ও মূল্যবোধে আখ্যায়িত করেছেন। এসব সাংস্কৃতিক আদর্শ বা নমুনা দ্বারা বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিক মানুষের পরিপূর্ণ জীবন প্রণালীকে তুলনামূলকভাবে জানতে পারা যায়। নিম্নে সাংস্কৃতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. উপসংস্কৃতি : মানবসমাজ হলো স্তরবিন্যস্ত। এ স্তরবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বসবাস করে। এদের জীবনধারার মধ্যে বেশ তারতম্য বা স্বাতন্ত্র্য বর্তমান থাকে। সাধারণত জীবনধারার মধ্যে এ স্বাতন্ত্র্যকে উপসংস্কৃতি বলা হয় । এ উপ সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। যেমন- আচার অনুষ্ঠান, ভাষা, ভাবনা প্রভৃতি। সব সমাজেই উচ্চ শ্রেণীর বা স্তরের মানুষের মত অপেক্ষাকৃত নি শ্রেণীর বা স্তরের মানুষের জীবন প্রণালী স্বাভাবিকভাবেই স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। অন্যদিকে, সামাজিক স্তরবিন্যাসের কারণ হিসেবে অর্থনীতিক ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবধানের কথা বলা হয়। এ স্তরবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের জীবনধারা বা জীবনযাপন প্রণালী অভিন্ন রকম হয় না। অর্থাৎ এ পার্থক্য বা স্বাতন্ত্র্যই হলো উপসংস্কৃতি । এ উপসংস্কৃতির ঐশ্বর্য ও বৈচিত্র্য মূল সংস্কৃতিকে মহিমায় ও মর্যাদামণ্ডিত করে তোলে ।
২. সাংস্কৃতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ : সব সমাজেরই কতকগুলো অনুমোদিত কর্মপদ্ধতি থাকে। এগুলোর মাধ্যমে সমাজের লক্ষ্যসমূহ নির্ধারিত হয়। সামাজিক কাজকর্মের এসব অনুমোদিত ধরন বা রীতিসমূহকে সাংস্কৃতিক আদ
র্শ বলা হয়। বস্তুত আদর্শের মধ্যে সাংস্কৃতিক সকল বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যক্তির আচরণের আদর্শিক ধরন নিয়মাচারের মধ্যে মূর্ত থাকে। লোকাচার, অলঙ্ঘনীয় লোকরীতি, আইন প্রভৃতি সাংস্কৃতিক নিয়মাচারের বিভিন্ন রূপ। আবার সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ৷ হচ্ছে সামাজিকভাবে নির্ণীত এবং সৃষ্ট। এগুলোকে সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও বাঞ্ছিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৩. সাংস্কৃতিক প্রকরণ : একটি সমাজের মধ্যে প্রচলিত নিয়মকানুন অনুসরণের ক্ষেত্রে সদস্যদের মধ্যে যে তারতম্য লক্ষ্য করা যায় তাকেই সাংস্কৃতিক প্রকরণ বলে। এ প্রকরণকে তিনভাবে ভাগ করা যায়। যথা : সর্বজনীন, বিকল্প এবং বিশেষক। যেসব নিয়মকানুন সমাজে সকলকে অবশ্যই পালন করতে হয় তাকে সর্বজনীন নিয়মাচার বলে এবং এ
সর্বজনীন নিয়মাচারসমূহের মধ্যে ব্যক্তিভেদে তা পালনের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পার্থক্যকে বিকল্প বলা হয় এবং যেসব নিয়মাচার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা দলের ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের কারণে কেবল তাদের জন্যই এগুলো যথোপযুক্ত বিবেচনা করা হয় সেগুলোকে ‘বিশেষক’ বলা হয়।
৪. গণসংস্কৃতি : সাধারণত গণসংস্কৃতির ধারণাটি গণসমাজের ধারণা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। আধুনিক শিল্প সমাজের উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময়, ভোগ তথা জীবনযাপন প্রণালীর মধ্যে যে সাধারণ সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় তাতে মনে করা হয় যে, সমাজকাঠামো ও কার্যকরণের ক্ষেত্রে কতকগুলো অভিন্ন বৈশিষ্ট্য সে সমাজের জনসাধারণকে একটি ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে রেখেছে তাই যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নতি এবং গণসংযোগ মাধ্যমসমূহের নিরবচ্ছিন্ন সামাজিকীকরণই কার্যত গণসমাজের মূলভিত্তি।
৫. ফ্যাশন : অধিকাংশ সমাজেই প্রচলিত আচারব্যবহার এবং পোশাক পরিচ্ছদের নতুনত্ব ও বৈচিত্র্য আনয়নের জন্য সাময়িকভাবে প্রচলিত যে ধারার পরিবর্তন করা হয় তাকে ফ্যাশন বলে। এ ফ্যাশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমাজে অবশ্য পালনীয় আচার হিসেবে যা প্রচলিত থাকে তার সাথে সংগতি রেখে পরিবর্তনের ধারা প্রবর্তিত করা। এ ফ্যাশন সমাজে ক্ষণস্থায়ী বা অল্পদিনের জন্য প্রবর্তিত হয় এবং এ ফ্যাশনের সাথে সামাজিক মূল্যবোধের কোন সম্পর্ক নেই।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, মানুষের সামগ্রিক জীবনধারণাই হলো সংস্কৃতি। অন্যভাবে বলা যায়, সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের অর্জিত আচার আচরণের বিধিবিধানকে সংস্কৃতি বলে । এ সংস্কৃতির দ্বারা মানুষ বস্তুজগতের বা প্রাণিকুলের মধ্যে স্বতন্ত্র বা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হিসেবে চিহ্নিত। বস্তুত সংস্কৃতি হলো মানুষের সামগ্রিক কার্যক্রমের সমষ্টি।