অথবা, শিশুর সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে শিশুদের সমস্যাসমূহ উল্লেখপূর্বক এর সমাধান প্রক্রিয়া আলোচনা কর।
অথবা, শিশুর সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে শিশুদের সমস্যাসমূহ ও সমাধানের উপায়
আলোচনা কর।
অথবা, শিশুর বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে বিদ্যমান শিশুদের সমস্যা ও সমাধানের উপায় আলোচনা কর।
অথবা, শিশুর পরিচয় প্রদানপূর্বক বাংলাদেশে বিদ্যমান শিশুদের সমস্যা ও সমাধানের কৌশল আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : একটি দেশ তথা জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার হল শিশু। কারণ আজকের শিশুই আগামীদিনের দেশ ও জাতির পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবে। তাই বর্তমান বিশ্বে শিশুর চাহিদা ও প্রয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের সমস্যা মোকাবিলার প্রচেষ্টা চালানো হয়। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এ প্রচেষ্টা বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোও এ ব্যাপারে আস্তে আস্তে সচেতন হচ্ছে। পেশাদার সমাজকর্মেও শিশু এবং শিশুকল্যাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত। তাই সমাজকর্মের ছাত্র হিসেবে আমাদের শিশু, শিশুর সমস্যা, সমস্যা সমাধান কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন।
‘শিশু : সাধারণ অর্থে জন্ম থেকে যুবক বয়সে উপনীত হওয়ার পূর্ব বয়সে অবস্থানকারী সকল মানব সন্তানকেই শিশু বলা যায়। তবে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী শিশু বলতে একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমায় অবস্থানকারীদের বুঝিয়েছেন। যেমন—
জাতিসংঘের মতে, “১৮ বছরের নিচে সব মানব সন্তানকেই শিশু বলা হবে, যদি না শিশুর জন্য প্রযোজ্য আইনের আওতায় ১৮ বছরের আগেও শিশুকে সাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।”
বাংলাদেশ করখাতের জাতীয় শিশু নীতি (১৯৯৪) অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সি ছেলেমেয়েদের শিশু বলে অভিহিত করা হয়।
ILO কনভেশন অনুযায়ী ১৫ বছরের নিচের মানব সন্তানকে শিশু বলা হবে। (১৩৮নং কনভেশন)
Bangladesh national plan of action for children (Ministry of women and children affairs, 1999) CRC এর মতে ১৮ বছরের কম বয়সীদেরকেই শিশু বলে অভিহিত করা হয়।
সুতরাং আলোচ্য মতামতগুলোর আলোকে আমরা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ০ – ১৮ বছর বয়সসীমার মধ্যে অবস্থানকারীদেরকে শিশু হিসেবে গণ্য করব।
বাংলাদেশের শিশুদের সমস্যাসমূহ : আমাদের দেশে শিশুদের মাঝে তাঁদের সার্বিক চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ না হওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো নিম্নরূপ :
১. প্রতিবন্ধী শিশু : যেহেতু শিশুর চাহিদা তার মাতৃগর্ভ থেকে শুরু হয় তাই মায়ের পেটে থাকাকালীন মা যদি যথাযথ পরিচর্যা না পায় তবে তা শিশুকে প্রভাবিত করে। মা যদি কোন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন, অতিরিক্ত ঔষধ গ্রহণ করেন তবে ঐ মা অনেক সময়ই প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম দিয়ে থাকেন।
২. পুষ্টিহীনতা : মানুষের দেহে ছয়টি খাদ্য উপাদান যখন সঠিক মাত্রায় না থাকে অর্থাৎ কোন কোন উপাদানের ঘাটতি থাকে তখন সে অবস্থাকে পুষ্টিহীনতা বলে। আমাদের দেশে প্রায় ৭০% শিশু পুষ্টিহীনতার শিকার। কারণ দেখা যায়, আমাদের অধিকাংশ জনসাধারণই দরিদ্র। ফলে তাদের পক্ষে তাদের শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার প্রদান করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব শিশুরা ব্যাপকহারে পুষ্টিহীনতার শিকার হয়।
৩. নিরাপত্তাহীনতা : শিশুরা হল সমাজের সবচেয়ে অক্ষম ও অসহায় শ্রেণী। তাদের চাহিদা তাদের নিজেদের দ্বারা পূরণ করা আদৌ সম্ভব নয়। এজন্য তাদেরকে তাদের মা-বাবা, পরিবার তথা সমাজের উপর নির্ভর করতে হয়। শিশুদের চাহিদা যদি যথাযথভাবে পূরণ না হয় তবে তাদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠা এমনকি বেঁচে থাকার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
৪. শিশু নির্যাতন : নির্যাতন হল একধরনের আঘাত বা ক্ষতি। শিশুরা অনেক সময় দেখা যায় নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। এসব ক্ষেত্রে তাদের পারিশ্রমিক তো দেওয়া হয়ই না, তার উপরে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ করা হয়।
৫. শিশু অপরাধ : সমাজকর্তৃক অসমর্থিত অথচ শিশু বয়সীদের দ্বারা সংঘটিত কর্মকাণ্ডই সমাজে শিশু অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। শিশুদের চাহিদা পূরণ না হওয়ার ফলে তারা অপরাধমূলক কাজে প্রবৃত্ত হয়। যেমন- কোন শিশু যদি নিয়মিত খাবার না পায় তবে সে ক্ষুধার তাড়নায় খাবার চুরি করতে বাধ্য হয়। আস্তে আস্তে চুরি বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করে।
৬. নৈতিকতার অবক্ষয় : ভালোমন্দ, সঠিক বেঠিক ইত্যাদি উপলব্ধি করা এবং ইতিবাচক বিষয়টি গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই নৈতিকতার প্রকাশ পায়। যে শিশু সত্য মিথ্যা, ভালোমন্দ সম্পর্কে শিক্ষা পায় না, যে আদর, স্নেহ, মমতা বঞ্চিত পরিবেশে বেড়ে উঠে তার মধ্যে নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা দেয়। সত্য মিথ্যা, ভালোমন্দ এসবের কোন অনুভূতি তার মধ্যে দেখা যায় না।
৭. সামাজিকীকরণের অভাব : সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। পরিবার থেকে শিশুর এ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু যে পরিবারে শিশুর চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ হয় না সে পরিবারের শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। ফলে শিশু সমাজের উপযোগী আচরণ প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়। সামাজিকভাবে নিজেকে খাপখাওয়াতে ব্যর্থ হয়।
৮. নেশাগ্রস্ততা বৃদ্ধি : বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত শিশু শ্রমিকরা, অবহেলিত ও পরিত্যক্ত শিশু যারা রয়েছে তারা অনেক সময়ই দেখা যায় অসৎ সঙ্গের সংস্পর্শে চলে আসে। ফলে তাদেরকে ধূমপান, যেমন- বিড়ি, সিগারেট আবার মাদক দ্রব্য
সেবনে উৎসাহিত করা হয়। ফলে দেখা যায়, একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ ব্যাহত হয়।
৯: শিশু পাচার বৃদ্ধি : চাহিদা অপূরণজনিত সমস্যার কারণে শিশুরা শিশু পাচারজনিত সমস্যায় পতিত হয়। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের কাজের আশায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রদান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক শিশু পাচার হয়ে যায়।তাই শিশু পাচারজনিত সমস্যা বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় উপনীত হয়েছে।
বাংলাদেশের শিশুদের সমস্যা সমাধানের উপায় : আমাদের শিশুদের মাঝে বিদ্যমান এসব সমস্যা মোকাবিলা/সমাধানের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে :
১. সুষম খাদ্য নিশ্চিতকরণ : খাদ্য মানুষের দেহের বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধন, ক্ষয়পূরণ ও রোগ প্রতিরোধে সহায়ক হয়।তবে এ খাদ্য হবে অবশ্যই সুষম। শিশুদের জন্য সুষম খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। ফলে তারা সুস্থসবল, রোগমুক্ত ও হাসিখুশির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠবে। পরবর্তীতে দেশ ও জাতির উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।
২. শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি : শিক্ষিত নাগরিক দেশের সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য। আমাদের দেশের সকল শিশু শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে একই ধরনের সুযোগ পায় না। যেসব এলাকার শিশুরা বর্তমানে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ঐসব এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন এবং শিক্ষা উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মোটকথা, দেশের কোন শিশুকেই শিক্ষা লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এক্ষেত্রে সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে।
৩. দরিদ্রতা দূরীকরণ : আমাদের দেশের শিশুরা ব্যাপকভাবে দারিদ্র্যের শিকার। এ দরিদ্রতা তাদেরকে নেতিবাচক পথে পরিচালিত করে। তারা জড়িয়ে পড়ে অনৈতিক এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। তাই শিশুদেরকে এ দারিদ্র্যাবস্থা থেকে
মুক্তি দিতে হবে। তাদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদনের সুবিধা দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে শিক্ষাজীবনে উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষা ঋণ প্রদান, দুর্যোগকালীন অনুদান প্রদান করা যেতে পারে।
৪. শিশু নির্যাতন রোধ : আমাদের শিশুদেরকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও পারিবারিক শোষণ ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে হবে। তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মে নিয়োগ থেকে বিরত রাখা, শিশু পাচার রোধ, শিশুদের যৌন হয়রানি বন্ধকরণজনিত কল্যাণমূলক পদক্ষেপ শিশুদের জন্য প্রণয়ন করতে হবে। দেশে প্রচলিত শিশু অধিকার আইনের যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
৫. সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ : সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, যার সূত্রপাত হয় মানুষের জন্ম থেকে এবং পরিবার সামাজিকীকরণের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের শিশুদের সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপযোগী ধ্যানধারণা, আদর্শ বিশ্বাস ও মূল্যবোধ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে এবং তা মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, আমাদের দেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের বহুমুখী সমস্যা বিদ্যমান, যার জন্য তারা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে। তাই বলা যায়, এ দেশের শিশুদের সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচ্য সুপারিশগুলো গ্রহণ সাপেক্ষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।