অথবা, শিল্প মনোবিজ্ঞানের আওতা বা পরিধি লিখ।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : বর্তমান শিল্পায়নের যুগে শিল্প মনোবিজ্ঞান খুবই যুগোপযোগী একটি ফলিত মনোবিজ্ঞান। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধানকল্পে ইউরোপ এবং আমেরিকায় শিল্প মনোবিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়। শিল্পকারখানার বিভিন্ন উপাদান এবং মানুষের মনোভাবের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি করাই শিল্প মনোবিজ্ঞানের প্রধান কাজ । শিল্প মনোবিজ্ঞান শিল্পকারখানায় শ্রমিক নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি মূল্যায়ন, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন, উৎপাদনের কর্মপরিবেশ সৃষ্টি এসব ক্ষেত্রে বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি শিল্প মনোবিজ্ঞানের পরিধি ও বিষয়বস্তু দিন বেড়ে যাচ্ছে।
শিল্প মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বা পরিসর বা পরিধি : শিল্পকারখানা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিল্প মনোবিজ্ঞানের পরিসরও ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়েছে। নিম্নে শিল্প মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বা পরিসর বা পরিধি সংক্ষপে বর্ণনা করা হলো :
১. কর্মী নির্বাচন : শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দক্ষ এবং পারদর্শী কর্মী নির্বাচন করা আবশ্যক। আর সঠিক স্থানে সঠিক দক্ষ কর্মী নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিল্প মনোবিজ্ঞান চমৎকার ভূমিকা পালন করতে পারে। নির্বাচনের আদর্শ নির্ণয়, কর্ম সাফল্যের পূর্বানুমান, নির্বাচন কৌশল নির্ধারণ, নির্বাচন কৌশলসমূহের যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা মূল্যায়ন ইত্যাদি সামগ্রিক নির্বাচন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।
২. কর্ম ও কর্মী বিশ্লেষণ : কর্ম ও কর্মী বিশ্লেষণ শিল্প মনোবিজ্ঞানের প্রধান বিষয়বস্তু। শিল্পক্ষেত্রে নানা প্রকার সমস্যা সমাধানের জন্য শিল্প মনোবিজ্ঞান কাজের প্রকৃতি কি এবং কোন পদ্ধতিতে কর্ম সম্পর্কে সঠিক তথ্যসংগ্রহ করা যাবে, তা আলোচনা করে। এছাড়া কর্মীর মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য, যা শিল্পের উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত, শিল্প মনোবিজ্ঞান তা নিয়েও আলোচনা করে।
৩. শিল্পে প্রশিক্ষণ : শিল্পকারখানায় কর্মচারীদের দক্ষতা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শিল্প মনোবিজ্ঞান নানা প্রকার প্রশিক্ষণ যেমন- কলাকৌশল, ব্যবস্থাপনা, পরিদর্শন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বর্ণনা করে। এর ফলে কর্মচারীর অনুপস্থিতি, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, কর্মজীবনে নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি হ্রাস পায় এবং কর্মসম্পাদনের গুণগত এবং পরিমাণগত উন্নতি সাধিত হয়।
৪. কর্মসন্তুষ্টি ও কর্মচারীর মনোবল : কর্মসন্তুষ্টি একদিকে যেমন কর্মচারীর মনোবল বৃদ্ধি করে অন্যদিকে, শিল্পের উৎপাদনও বাড়ায়। কর্মসন্তুষ্টি ব্যক্তির নিজের কাজের ইতিবাচক স্বীকৃতি দ্বারা তার মনের ভিতর আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে। কর্মসন্তুষ্টির কারণে ব্যক্তি নিজেকে যোগ্য হিসেবে ভাবতে পারে। আর নিজেকে নিয়ে এ ইতিবাচক ভাবনা ব্যক্তিকে অনেক কঠিন কাজ সম্পাদন করতে সহায়তা করে।
৫. মনোবল বৃদ্ধি : মনোবলই কোনো কাজের সাফল্যের একটা বিরাট হাতিয়ার, শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। আর এ মনোবল বৃদ্ধির কারণে শিল্পে নিয়মকানুন, আইনশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে। একজন কর্মীর সাথে অন্য কর্মীর সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে এবং শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মীদের কর্মদক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে।
৬. প্রকৌশল মনোবিজ্ঞান : প্রকৌশল মনোবিজ্ঞানের আলোচ্যবিষয় হচ্ছে যন্ত্রপাতির ডিজাইন নির্ধারণ করা, যাতে করে যন্ত্রপাতি ব্যক্তির পরিচালনার ক্ষমতার উপযুক্ত করে তৈরি করা যায়। যন্ত্রপাতির নিয়ন্ত্রণ সহজসাধ্য করতে পারলে কম পরিশ্রমে বেশি উৎপাদন সম্ভব।
৭. শিল্পে ‘মানবিক সম্পর্ক : শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সুন্দর সাবলীল পরিচালনা, উৎপাদন বৃদ্ধি, দুর্ঘটনা হ্রাস প্রভৃতি অনেকাংশে নির্ভর করে শ্রমিক কর্মচারীদের সুসম্পর্ক বা সদভাবের উপর। শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপক সম্পর্ক ভালো হলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উপর অনুকূল মনোভাব গড়ে উঠে।
৮. শিল্পে দুর্ঘটনা : শিল্পক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এবং এর প্রতিকার শিল্প মনোবিজ্ঞানের একটি অর্থবহ বিষয়। শিল্পক্ষেত্রে যত সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে দুর্ঘটনা সবচেয়ে মারাত্মক একটি বিষয়। দুর্ঘটনার কারণ, আকৃতি, প্রকৃতি, ফলাফল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শিল্প মনোবিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত ব্যাকুল। তারা পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করে দেখেছেন যে, শিল্পক্ষেত্রে দুর্ঘটনা কোনো দৈব ব্যাপার নয়।
৯. দক্ষতা ও ক্লান্তি : যে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সঠিক এবং প্রত্যাশিত কর্ম সার্বিকভাবে সম্পাদন করতে হলে ব্যক্তিকে দক্ষতা ও যোগ্যতার বিকাশ ঘটাতে হয়। আর কোনো কার্যক্রম পরিসমাপ্তি করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্তি আসে। এ ধরনের ক্লান্তির কারণ শনাক্ত, এ থেকে সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং ক্লান্তি ও একঘেয়েমির কারণ খুঁজে বের করা শিল্প মনোবিজ্ঞানের খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।
১০. সময় ও গতি অনুধ্যান : সময় ও গতি অনুধ্যানের প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিল্প থেকে অপচয় এবং অদক্ষতা অপসারণ করা। কোন একটি কাজ পরিসমাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের আদর্শ মান নির্ণয় করাই হলো সময় অনুধ্যানের লক্ষ্য। অন্যদিকে, গতি অনুধ্যানের লক্ষ্য হল কোন একটি কাজ সম্পাদনের জন্য অদরকারি গতি হ্রাস করে সবচেয়ে কার্যকরী গতিবিধি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতি আলোচনা করা। তাই শিল্প উৎপাদনের বেলায় এ দুইটি অনুধ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম।
উপসংহার : উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় – যে, শিল্প মনোবিজ্ঞান প্রকৃতপক্ষে শিল্পক্ষেত্রে ও ব্যবসায় বাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত কর্মচারীদের আচরণ ও সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনা করলেও বর্তমানে শিল্পোন্নতি ও শিল্প সমস্যার সাথে এর পরিসর প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক শিল্প কর্মীদের উন্নয়ন, তাদের কর্মে উৎসাহ প্রদান এবং মানবিক ও আবেগজনিত সমস্যার সমাধানসহ শিল্পে সর্বাপেক্ষা উৎপাদন ও । মুনাফা বৃদ্ধির প্রায় সব ক্ষেত্রেই মনোবিজ্ঞানের পরিধি বিদ্যমান। । শিল্পের যন্ত্রপাতি এবং মানব সম্পদের সবকিছুই শিল্প মনোবিজ্ঞানের আওতার মধ্যে পড়ে।