শিল্পক্ষেত্রে একজন মনোবিজ্ঞানী যেসব ভূমিকা পালন করে তা লিখ। উত্তর ভূমিকা : মনোবিজ্ঞান হলো মানুষ ও প্রাণীর আচরণ এবং মানসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত বিজ্ঞান। এটি জ্ঞানের অতি বিশ্লেষণধর্মী শাখা, যা মানুষের আচরণকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে। মনোবিজ্ঞান শুধু আচরণ সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা করে না বরং এর প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক দিক সম্পর্কেও আলোচনা করে। মানুষের আচরণ সম্পর্কিত গবেষণা এ বিজ্ঞানের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে আরও বেশি তথ্যবহুল করেছে। ব্যবহারিক জ্ঞানের সাহায্যেও মানুষ বাস্তবিক সমস্যা সমাধানে পদ্ধতি শিখেছে।
শিল্প মনোবিজ্ঞানীর কর্মপরিধি : বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে শিল্পোন্নয়নের সাথে সাথে উৎপাদন ও বিপণন ক্ষেত্রের ব্যাপকতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যবস্থাপনার জটিলতা এবং সমস্যাও। এর পরিপ্রেক্ষিতে মনোবিজ্ঞানিগণ এবং ব্যবস্থাপনা বিশারদগণও চুপচাপ বসে থাকেনি। তারা সর্বক্ষণ চিন্তাভাবনা এবং গবেষণা করছেন কিভাবে প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বচ্ছন্দময় ও উৎপাদনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা যায়। শিল্পক্ষেত্রে একজন মনোবিজ্ঞানীর বিরামহীন শ্রম আর প্রচেষ্টার জন্যই সম্প্রতি শিল্পের এত উন্নতি ও প্রসার ঘটেছে। নিম্নে একজন শিল্প মনোবিজ্ঞানীর কর্মপরিধি বা ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
১. প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা গ্রহণ : মনোবিজ্ঞানী প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শিল্পে নিয়োজিত কর্মীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ, পরস্পরের প্রতি সহযোগী করে তোলেন। এর ফলে কর্মী এবং দলগত প্রচেষ্টা সুসংহত ও ফলপ্রসূ হয়। এতে শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
২. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন : শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠনে সহায়তা করে থাকেন, যাতে কর্মীরা তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও মেধা বিকাশের সুযোগ পায় এবং বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সঠিক সুন্দর যোগাযোগের সুযোগ হয়।
৩. ক্লান্তি, গতি ও সময় নিরীক্ষা : মনোবিজ্ঞানী শ্রমিকদের গতি সময় পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান যে, শ্রমিকরা কত সময় পরে এবং কিভাবে ক্লান্ত হয় অথবা অযথা ঘোরাফেরা করে সময় বিনষ্ট করে। তারা ক্লান্তি এবং সময় অপচয়ের কারণ শনাক্ত করেন ও সময়মতো বিশ্রাম ও তার প্রতিকারের সুব্যবস্থা করেন।
৪. কর্মচারী নির্বাচন ও সংস্থাপন : শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সবাই সব ধরনের কাজের জন্য যোগ্য নয়। যারা যে ধরনের কাজের জন্য যোগ্য এবং দক্ষ, তাদের সে ধরনের কাজের জন্য সুপারিশ করে একটি দক্ষ কর্মী দল। এভাবে দক্ষ কর্মীদল কর্মচারী নির্বাচনে ও সংস্থাপনে শিল্প মনোবিজ্ঞানীকে সাহায্য করে থাকে।
৫. পরিবেশ উন্নয়ন : প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশ এবং প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ কিভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করে এবং উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় মনোবিজ্ঞানিগণ তা অত্যন্ত সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং তা প্রতিরোধের উপায় নির্ধারণ করে দেন।
৬. জনশক্তি উন্নয়নে গবেষণা : মনোবিজ্ঞানী প্রকৃতপক্ষে মানুষের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেন। এজন্য শিল্পে জনশক্তির আচরণ নিয়ে গবেষণায় তিনি অবশ্যই দক্ষতার পরিচয় দেন। জনশক্তির উন্নয়নের জন্য তিনি পরীক্ষামূলকভাবে কর্মীর নির্দিষ্ট মনোভাব নির্বাচন করে নেন।
৭. দরকষাকষি : শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে দরকষাকষি যেন শিল্পের উৎপাদন ব্যয়ের পক্ষে আসে এবং মালিক শ্রমিক সম্পর্কের উন্নতি হয় সে চেষ্টায় মনোবিজ্ঞানী সচেতন থাকেন। এতে শিল্পের সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে।
৮. প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন : কর্মীর কর্মদক্ষতা পুরোটাই নির্ভর করে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের উপর। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মীর জ্ঞান ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় এবং তার আচরণের আমূল পরিবর্তন করা যায়। শিল্প মনোবিজ্ঞানী কর্মীর যোগ্যতা ও কার্য অনুযায়ী দরকারি প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করেন।
৯. মনোভাব গঠন : কর্মীদের সর্বোচ্চ আর্থিক সুযোগ সুবিধা এবং কর্মসন্তুষ্টি থাকলেই যে তারা শিল্পের উৎপাদনে তাদের সমুদয় শক্তি দিয়ে কাজ করবে একথা ঠিক নয়। শিল্পের প্রতি কর্মীদের প্রকৃত অভিযোগ খুঁজে বের করে তার সমাধান করে তাদের উৎপাদনমুখী মনোভাব কিভাবে সৃষ্টি করা যায় তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানী সর্বদা ব্যাকুল থাকে।
১০. শৈল্পিক পরামর্শ : পরামর্শ দাতা হিসেবে মনোবিজ্ঞানী শিল্পের উৎপাদন এবং বিক্রয় বিভাগকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারেন। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নত করতে, তাদের মনোবল এবং কাজের আগ্রহ বৃদ্ধি করতে, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসন করতে মনোবিজ্ঞানী সবসময় পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে একজন মনোবিজ্ঞানীর দায়িত্ব অতুলনীয়। প্রকৃতপক্ষে মনোবিজ্ঞানের একটি ফলিত শাখা হিসেবে শিল্প মনোবিজ্ঞান যেসব আচরণ কর্মীর উৎপাদন ক্ষমতা ও শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে সে আচরণের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করে থাকে।