ভূমিকা : শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত সমস্যার সমাধানকল্পে বিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকা এবং ইউরোপে শিল্প মনোবিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে সৃষ্ট মারাত্মক মানসিক সমস্যাবলি সমাধানে ফলিত মনোবিজ্ঞানীদের দৃষ্টান্তমূলক অবদানের কারণে শিল্প মনোবিজ্ঞান বিশেষভাবে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ এবং আংশিকভাবে এশিয়া এবং আফ্রিকায় দ্রুত বিকাশ ও বিস্তার লাভ করে। তবে ব্রিটিশরা শিল্প মনোবিজ্ঞান উদ্ভাবের পিছনে তাদের কৃতিত্বকে অনেক বড় করে দেখে ।
শিল্প মনোবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক পটভূমি : শিল্প মনোবিজ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে যেসব মনোবিজ্ঞানী জড়িত ছিলেন, তাদের মধ্যে ডব্লিউ. ডি. স্কটের নাম বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ১৯০১ সালে তিনি যখন নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তখন ওয়েস্টার্ন এডভারটাইজিং কোম্পানির ম্যানেজার ব্যালমার তাকে বিজ্ঞাপন বিষয়ক ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানের ব্যবহারের উপর একটি প্রবন্ধ পড়ে শোনাতে বলেন। স্কট প্রথমদিকে মনোবিজ্ঞানী মুনস্টারবার্গ ও থর্নডাইকের মত এ ব্যাপারে সম্মতি জানালেও পরে তিনি স্বীকৃতি জানান। ১৯০১ সালের ২০ ডিসেম্বর শিকাগোর অ্যাগেট ক্লাবে (Agate Club বিজ্ঞাপনের বিষয়ে কিভাবে মনোবিজ্ঞানকে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে তিনি বক্তব্য প্রদান করেন। একই সময় একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার প্রধান বিজ্ঞাপন বিষয়ক তার বক্তব্যটি শ্রবণ করেন এবং | তার লেখা বিজ্ঞাপন বিষয়ক একটি সাময়িক পত্রিকায় ছাপার ব্যবস্থা করেন। এ পত্রিকায় স্কটের একাধিক প্রবন্ধ পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়। এভাবে আমেরিকায় প্রথম শিল্পক্ষেত্রে এবং ব্যবসায় মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ শুরু হয়। নিম্নে শিল্প মনোবিজ্ঞানের ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করা হলো :
১. শিল্প মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক গবেষণা : শিল্প মনোবিজ্ঞানের প্রথম পর্যায়ের গবেষণা আরম্ভ হয় ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বিক্রয় নৈপুণ্য গবেষণা সংস্থার মাধ্যমে। স্কট ছিলেন। এ সংস্থার পরিচালক এবং তার দু’জন সহযোগী ছিলেন, | ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক হুইপেল ও বিংহাম। তারা ডেট্রয়েটে অনুষ্ঠিত বিশ্বের প্রথম বিক্রয় নৈপুণ্য সম্মেলনে বিক্রেতা নির্বাচনে প্রচলিত কৌশলের দোষত্রুটি তুলে ধরেন এবং বিক্রেতা নির্বাচনে সুষ্ঠু কৌশল এবং বিক্রয় নৈপুণ্য বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন। এভাবে তারা ব্যবসায়ীদের মতামতের পরিবর্তন করান এবং কর্মী নিয়োগের বেলায় একটি | উন্নতমানের নির্বাচনী অভীক্ষার আবিষ্কার করেন।
২. প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন শিল্প মনোবিজ্ঞান : শিল্প মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো বিগত | দুইটি বিশ্বযুদ্ধকালীন সেনাবাহিনীতে মনোবৈজ্ঞানিক অভীক্ষার প্রয়োগ। মনোবিজ্ঞানের নিয়ম এবং পদ্ধতিসমূহ কর্মীদের সমস্যা সমাধানে প্রথম গুরুত্ব পায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী নিয়োগে। তখন এই পরীক্ষা সেনাবাহিনীর পদবিন্যাস ও কার্যসম্পাদনে ব্যবহার করা হতো। এ সময়ই ইউরোপে Industrial Fatigue Research Board’ গড়ে উঠে। এবং উদ্দেশ্য ছিল ক্লান্তি কাজের সময়, কার্যপরিবেশ এবং অন্যান্য বিষয়ের ব্যাখ্যা ও উন্নয়ন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলমান সময়ে আমেরিকার মনোবিজ্ঞান সমিতিও সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগের তাগিদে দু’টি অভীক্ষার উদ্ভব ঘটায়। অভীক্ষা দুটি হলো শিক্ষিতদের জন্য অভীক্ষা ‘এ’ এবং নিরক্ষরদের জন্য অভীক্ষা ‘বি’। সেনাবাহিনীতে উপযুক্ত লোক নির্বাচন, শ্রেণিবিন্যাস এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে অভীক্ষা দুটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩. কর্মচারী সংক্রান্ত পরামর্শ দান সংস্থা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর ১৯১৯ সালে এই সংস্থা বিকাশ লাভ করে। এই সংস্থারও পরিচালক ছিলেন স্কট। সাধারণ লোকদের নিকট এটি পরিচিতি লাভ করে স্কট কোম্পানি নামে। এ সংস্থা ব্যবসায় বাণিজ্য এবং | সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে এবং তাদের নানা | প্রকার পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে থাকে।
৪. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন শিল্প মনোবিজ্ঞান : আমেরিকা মহাদেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের সাথে সাথে সেনা এবং নৌবাহিনীতে লোক নিয়োগের এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য মনোবিজ্ঞানীদের নিয়োগের প্রয়োজন অনুভব করে এবং নিয়োগও করে। এই কর্মসূচি শুধু যুদ্ধকালীন সময়েই ফলপ্রসূ হয়নি, পরবর্তী কালে মনোবিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্যতাকেও স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৪৫ সালে আমেরিকার মনোবিজ্ঞান সমিতি (এ পি এ) কর্তৃক শিল্প এবং ব্যবসায় মনোবিজ্ঞানের যে শাখা বা বিভাগ চালু করা হয়, তাই শিল্প মনোবিজ্ঞানের পেশাগত স্বীকৃতি প্রদান করে।
৫. হর্থন গবেষণা প্রকল্প : শিকাগোর ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিক কোম্পানির হর্থন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ১৯২৭ সালে এন্টন ম্যায়ো, রোয়েদ লিসবার্গার এন্ড ডিকসন প্রমুখ মনোবিজ্ঞানী কর্মপরিবেশ, দুর্ঘটনা ও একঘেয়েমি মনোভাবের সাথে সম্পর্ক নিরূপণ করার জন্য একটি গবেষণা প্রকল্প আরম্ভ করেন। গবেষণা প্রকল্পটি হর্থন গবেষণা নামে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। ঐ গবেষণার ফলে শিল্প মনোবিজ্ঞানের বিকাশ ও গতিধারায় সাড়া জাগানো পরিবর্তন। সাধিত হয়। তাছাড়া হর্থন গবেষণার ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সামাজিক সংগঠন ও মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপিত হয় এবং নেতৃত্ব তদারক ব্যবস্থা শিল্প সম্প্রীতি কর্মচারীর মনোবল। কর্মসন্তুষ্টি নানা প্রকার বিষয়বস্তু শিল্প মনোবিজ্ঞানে সংযুক্ত হয়। তখন থেকেই উৎপাদনকে সঠিক মানব সম্পর্ক যন্ত্রপাতি, কার্যপরিবেশ ও দক্ষ কৌশলের সমাবেশ হিসেবে পরিগণিত করার সূত্রপাত হয়। এ গবেষণাই শিল্প মনোবিজ্ঞানের নীতি প্রয়োগকে দ্রুততা দান করে। আর এ কারণেই এন্টন ম্যায়োকে কর্মক্ষেত্রে মানবীয় সম্পর্কের জনক বলা হয়।
৬. সাম্প্রতিককালে শিল্প মনোবিজ্ঞান : ১৯৪০-৫০ সালে কর্মী ব্যবস্থাপনায় কর্মীর মানবীয় দিকসমূহের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া আরম্ভ হয়। বিশেষ করে এসময় কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া কর্মী এবং দলের মধ্যে প্রতিক্রিয়া, তত্ত্বাবধান, যোগাযোগ, নেতৃত্ব ও কর্মসন্তুষ্টির উপর বেশি লক্ষ করা হয়। এসময় মানুষের কাজের সামাজিক দিকেও ধীরে ধীরে মনোবিজ্ঞানিগণ দৃষ্টিপাত করতে আরম্ভ করেন। তাই সাম্প্রতিক কালে কর্মী ব্যবস্থাপনায় যথার্থ ফল পাওয়ার জন্য শিল্প এবং প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান সব প্রতিষ্ঠানেই ব্যবহার করা হচ্ছে। শিল্প মনোবিজ্ঞানের জন্ম ও বিকাশ শুধু আমেরিকা ও ইউরোপেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বর্তমান সময়ে সমগ্র উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্প এবং ব্যবসায় ক্ষেত্রে নানা সমস্যা সমাধানের জন্য শিল্প মনোবিজ্ঞানকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়। যে, যদি কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান সুদূরপ্রসারী সর্বাধিক উৎপাদন অর্জন করতে চায়, তাহলে কর্মী ব্যবস্থাপনায় তাকে শিল্প মনোবিজ্ঞানের সুপরিকল্পিত এবং সুবিন্যস্ত নিয়মনীতিকে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। ষাট শতকের শুরুর দিকে প্রাতিষ্ঠানিক মনোবিজ্ঞানকে শিল্প মনোবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত করা হয়। বর্তমানে উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশে শিল্প মনোবিজ্ঞান এক যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করে চলছে। বর্তমান বিশ্বে শিল্পের প্রভাবে যে আবহাওয়া বিপর্যয় ঘটছে তার মোকাবিলাতেও শিল্প মনোবিজ্ঞান অবদান রাখাত প্যানে।