অথবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজি যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজি যৌক্তিকতা আলোচনা কর।
অথবা, শিল্পনীতির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান পুঁজি প্রত্যাহার নীতি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর ভূমিকা : বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় অদ্যাবধি অনুন্নত। শিল্পায়নের একটি দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রগতি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব। উন্নত রাষ্ট্রসমূহে জাতীয় আয়ের শতকরা ৫০-৮, ভাগ আসে শিল্পক্ষেত্র হতে অথচ অনুন্নত দেশসমূহে এর পরিমাণ শতকরা ৫ হতে ১৫ ভাগ মাত্র। এ কারণে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পের উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করছে। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান শতকরা মাত্র ৮ ভাগ। শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির হারও অত্যন্ত মন্থর। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন আমাদের শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ৩-৪ শতাংশ মাত্র। বাংলাদেশে যথেষ্ট কাঁচামালসহ প্রাকৃতিক সম্পদ, সন্তু শ্রমিক প্রভৃতি রয়েছে। তবুও এদেশে শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি।
বাংলাদেশ সরকারের পুঁজি প্রত্যাহার নীতি : রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ও সরকারি মালিকানায় পরিচালিত্ব শিল্পকারখানা, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরের মাধ্যমে সরকারের বিনিয়োগকৃত পুঁজি ফিরিয়ে নেয়াকে পুঁজি প্রত্যাহার নীতি বলা হয়। এ প্রক্রিয়াকে বেসরকারিকরণ নীতিও বলা হয়। সাধারণত দুটি উপায়ে পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়। যথা :
১. সরকার নির্দিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে বাজারে শেয়ার বিক্রি করে ঐ প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তর করতে পারে।
২. সরকার টেন্ডার বা দরপত্র আহ্বান করে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে ন্যায্য মূল্যে প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হস্তান্তর করতে পারে। সরকারের এ প্রক্রিয়াকে পুঁজি প্রত্যাহার নীতি বলা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮২ সালে ঘোষিত শিল্পনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাত
থেকে পর্যায়ক্রমে পুঁজি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নিম্নে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজি প্রত্যাহারের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হলো :
১. সরকারি খাতের আর্থিক দায় লাঘব : রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহের অদক্ষতার ফলে প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে এবং এসব শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ বা বেসরকারিকরণের ফলে সরকারের পক্ষে এ বিপুল আর্থিক ক্ষতির দায়ভার এড়ানো সম্ভব হবে।
২. বেসরকারি খাতের উন্নয়ন : শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ বা সরকারের পুঁজি প্রত্যাহার নীতি দেশে একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাতের বিকাশ সাধনে সহায়ক হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তাগণ দেশে নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত হবে।
৩. শ্রমিক-মালিকের সুসম্পর্ক : পুঁজি প্রত্যাহার করে সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দিলে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠার সুযোগ থাকে। মালিকরা সরাসরিভাবে কারখানায় উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত থাকে এবং উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে বলে তারা শ্রমিকদের সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কে অবহিত থাকে। পক্ষান্তরে, শ্রমিকরাও মালিকদের সুবিধা ও অসুবিধা বুঝতে পারে। এমতাবস্থায় মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে উৎপাদনকার্য বিঘ্নিত হয় না।
৪. পর্যাপ্ত পুঁজির সংস্থান : বাংলাদেশে দ্রুত শিল্পায়নের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থের যোগান দেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে সরকারের পক্ষে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় পুঁজির সংস্থান করা খুবই কঠিন।
বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য দেশি ও বিদেশি বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবে। এর ফলে দেশের দ্রুত শিল্পায়ন ঘটবে।
৫. উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা : পুঁজি প্রত্যাহার বা বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে বেসরকারি ব্যক্তি বা উদ্যোক্তারা শিল্পের মালিক হলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ে। বাংলাদেশে পুঁজি প্রত্যাহার ক্রমশ শক্তিশালী বেসরকারি খাত সৃষ্টিতে সহায়তা করছে।
৬. দক্ষতা ও কর্মনৈপুণ্য : পুঁজি প্রত্যাহার বা বিভাগীয় নীতি অনুসরণের ফলে শিল্পপতিরা দক্ষ ও কর্মনিপুণ হওয়ার সুযোগ পায়। বেসরকারি উদ্যোক্তারা অধিক মুনাফা ও অধিক উৎপাদনের আশায় দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সাথে শিল্পকারখানা পরিচালনা করে থাকে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৭. স্বাধীন উৎপাদন প্রক্রিয়া : বেসরকারি মালিকানায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের অবস্থিতি স্বাধীনভাবে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হয়। ব্যক্তিমালিকরা তাদের লাভলোকসান, ভালোমন্দ ইত্যাদি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে উৎপাদন ও বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বলে উৎপাদনকার্য থেকে দেশ উপকৃত হতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সরকারের বিরাষ্ট্রীয়করণ বা পুঁজি প্রত্যাহার নীতি ইতোমধ্যেই দেশের শিল্পায়নে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম হবে। সর্বোপরি, বর্তমানে দেশে প্রচলিত মুক্ত বাজার অর্থনীতির সাথে শিল্পের বিরাষ্ট্রীয়করণ বা পুঁজি প্রত্যাহার নীতি বিশেষ সংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের দ্রুত শিল্পায়নের স্বার্থে সরকারি খাতের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে মুক্ত বাজার অর্থনীতির বিকাশলগ্নে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পখাত হতে পর্যায়ক্রমে পুঁজি প্রত্যাহার এবং বেসরকারি খাতকে গতিশীল করে তোলার বর্তমান নীতিকে একটি যুক্তিসংগত ও সঠিক পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায়।