লাহোর প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল? আলোচনা কর।

অথবা, লাহোর প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাবের অংশ ছিল? বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ব্রিটিশ ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় লাহোর প্রস্তাব ছিল ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারতবর্ষে দুটি জাতি একটি মুসলমান অপরটি হিন্দু এ নীতির উপর ভিত্তি করে মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করা হয়। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে। মুসলমাদের জন্য সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে যাতে তারা নিজেদের সুচিন্তিত ইচ্ছানুযায়ী তাদের আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে এবং উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে স্বতন্ত্র আবাসভূমির নির্দেশ প্রদান করে লাহোর প্রস্তাবে।
লাহোর প্রস্তাব : ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের সভাপত্বিতে মুসলিম লীগের সভা
অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে শেরে বাংলা ফজলুল হক মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের লক্ষ্যে লাহোরে যে
প্রস্তাব উপস্থাপন করে তাকে লাহোর প্রস্তাব বলা হয়।
লাহোর প্রস্তাব কি পাকিস্তান প্রস্তাব : লাহোর প্রস্তাবে মূলত উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তান প্রস্তাব উল্লেখ ছিল না। কোথাও একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ ছিল না। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালে মূল লাহোর প্রস্তাব
সংশোধন করে। স্টেটস শব্দের পরিবর্তে স্টেট শব্দ ব্যবহার করে। পরবর্তীতে যখন পাকিস্তান নামে অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে তখন অনেকে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত করার চেষ্টা করে। ফলে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে জনপ্রিয়তা পায়।
১. পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত : ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার পরদিন কংগ্রেস প্রভাবাধীন পত্র পত্রিকাগুলো “পাকিস্তান প্রস্তাব” শিরোনামে লীগের প্রস্তাবের দাবিদাওয়া প্রকাশ করে। গ্রেট ব্রিটেনের পত্রপত্রিকাগুলোতেও পরবর্তীতে লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অভিহিত করা হয়। যা লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে পরিচিতি পায়।
২. জিন্নাহর অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন : ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে জিন্নাহ বলেন যে “পাকিস্তান শব্দটি তাঁর বা মুসলিম লীগের উদ্ভাবিত নয়। তিনি বলেন যে, সকলেই
জানে পাকিস্তান শব্দটি কিছু হিন্দু ও ব্রিটিশ পত্রিকা কর্তৃক তাদের উপর আরোপ করা হয়েছে, তবে তা পাকিস্তান প্রস্তাব নামেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেশি, জিন্নাহ আরো বলেন যে, কতদিনই বা এত বড় শব্দ ব্যবহার করা যায়। এজন্য (পাকিস্তান) প্রস্তাবটিকে অভিহিত করার জন্য তিনি সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তার অর্থ জিন্নাহর কথায় এটাই বুঝায় যে, প্রস্তাবটি প্রথমে লাহোর প্রস্তাব নামে অভিহিত হলেও তাঁর মনে আসলে অখণ্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল।
৩. একাধিক রাষ্ট্র মিলে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র : ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব বলতে একাধিক রাষ্ট্রের উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি পাকিস্তান নাম এক রাষ্ট্রের অর্থে ব্যবহার করেন। ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিন্নাহ ও গান্ধীর মধ্যে যে পত্র বিনিময় হয় তাতে জিন্নাহ প্রথম প্রকাশ করেন যে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠিত হবে। দুই অঞ্চলের প্রদেশগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে কি না জিন্নাহের কাছে গান্ধী সে বিষয়ে জানতে চান। উত্তরে গান্ধীকে তিনি জানান যে, প্রদেশগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে না, এগুলো পাকিস্তানের ইউনিট হবে।
৪. জিন্নাহের ভাবনা : জিন্নাহ ১৯৪৫ সালের ৮ নভেম্বর এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার প্রতিনিধিকে বলেন যে, পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হবে এবং এর প্রদেশগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত। আমেরিকা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন হবে এর মুদ্রা, জাতীয় প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য বিষয় যুক্তরাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কেন্দ্র সরকারকে দেওয়া হবে।
৫. লাহোর প্রস্তাব সংশোধন : ১৯৪৬ সালে মূল লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে স্টেটস শব্দের পরিবর্তে স্টেট শব্দ ব্যবহার করেন। লাহোর প্রস্তাবে এক রাষ্ট্রের অর্থে ব্যবহার করে জিন্নাহ এতে মূলগত পরিবর্তন আনয়ন করেন।
এ প্রস্তাবকে সামনে রেখে মুসলিম জনগণ মুসলিম জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।
৬. মূল্যায়ন : লাহোর প্রস্তাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, লাহোর প্রস্তাবের শুরুতে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল উত্তর- পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চল নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের কথা বলা হয়। যে রাষ্ট্রসমূহ হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম। কিন্তু পরবর্তীতে জিন্নাহ কৌশলে ১৯৪৬ সালে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মতামত দেয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব মুসলমানদের জন্য পৃথক পৃথক রাষ্ট্রসমূহ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু কংগ্রেস ও অন্যান্য গণমাধ্যম একে ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তান প্রস্তাব নামে উল্লেখ করতে থাকে। পরবর্তীতে জিন্নাহ এটাকে পাকিস্তানি প্রস্তাবে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যার ফলে লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিতি লাভ করে।