রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কী জান? এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।

অথবা, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ দাও।
অথবা, ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা কর।
অথবা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উপর একটি প্রবন্ধ লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
স্ভারতবর্ষের ইতিহাস তথা বাঙালি জাতির ইতিহাস হলো আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়েই বাঙালিরা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়াদেরকে উপমহাদেশ থেকে বিদায় করতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিতাড়িত করার পর বাঙালিরা পশ্চিমা বা শাসক চক্রের শোষণ, নির্যাতনের বিষয়ে পরিণত হয়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি : ১৯৪৭ সালে ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ভারতের দায়িত্বভার অর্পিত হয় জওহরলাল নেহেরুর উপর। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে ভাষাগত বিষয় নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়। নিচে এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা হলো :
১. ভাষার উপর আঘাত : পাকিস্তানি শাসনামলের প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। জাতির জনক বলে খ্যাত মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁর ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করার জন্য প্রথম ভাষার উপর আঘাত হানেন। পাকিস্তানে বাঙালিরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা উর্দুকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি মারাত্মক ভুল করেন। বাঙালিদের ভাষাগত স্বাধীনতা হরণের প্রথম প্রকাশ লক্ষ করা যায় জিন্নাহর ঘোষণাতে। জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেন যে, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” তাঁর এ ঘোষণায় বাঙালি জনসাধারণ প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। তারা দাবি জানালো যে, উর্দু ও বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। কারণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক পূর্ব বাংলায় বাস করে এবং তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু পশ্চিমা চক্র তা প্রাধান্য দেয়নি।
২. আঞ্চলিক আন্দোলনের সূচনা : ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ জিন্নাহর ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। তারা জিন্নাহর ঘোষণাকে অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারমূলক বলে ঘোষণা করে। কিন্তু জিন্নাহ বুঝতে পারেন যে, অলক্ষ্যে ঐদিন তিনি পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করলেন এবং এটা
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ পতনের পথ প্রশস্ত করল। এ সময় হতেই বাঙালি জাতি মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বদ্ধপরিকর হলো। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার দাবির সাথে জাতীয় চেতনা বেড়ে চলল এবং এতে আঞ্চলিক আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
৩. খাজা নাজিম উদ্দিনের ঘোষণা : ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর এ নিযুক্তি ছিল বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক। খাজা নাজিম উদ্দিন শাসনকার্যে তেমন দক্ষ ছিলেন না, তাই শাসনতান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়। খাজা নাজিম উদ্দিন ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি কায়েদে আজমের অনুকরণে ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তাঁর এ
ঘোষণায় পূর্ব বাংলার জনগণ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে। ফলে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করতে লাগল।
৪. রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন : খাজা নাজিম উদ্দিনের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হলো। পরে ভাষা আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হলো। এর সদস্য ছিলেন। জনাব আবুল হাশিম, জনাব আতাউর রহমা ন খান, জনাব কামরুদ্দীন আহমদ ও জনাব তোয়াহা প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
৫. ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা : সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ঘোষণায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য সারাদেশে হরতাল, সভা ও শোভাযাত্রার ডাক দেওয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি দিবসকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য এ দেশের সংগ্রামী ছাত্রজনতা ৪ ফেব্রুয়ারি হতে সক্রিয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। তাদের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পথসভা ও শোভাযাত্রার বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ সময় নুরুল আমীন ছিলেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। নুরুল আমীন সরকার ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় দীর্ঘ এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে সকল মিছিল, মিটিং, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এতে ছাত্রজনতা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
৬. ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ : ভাষা আন্দোলনের সাহসী সৈনিক বাংলার সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষা দিবসের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে, একই দিন (২১ ফেব্রুয়ারি) ছিল পাকিস্তান সরকারের বাজেট অধিবেশনের দিন। ছাত্রদের কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য সরকার পূর্বেই ১৪৪ ধারা জারি করেন। এ অবস্থায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা এক জরুরি বৈঠকে সমবেত হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক হরতাল পালনের মধ্যদিয়ে ছাত্ররা প্রতি দশজনের একটি মিছিল বের করে। এ আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য পুলিশ বাহিনী মাঠে নামে। ফলে ছাত্র মিছিলের উপর চলে লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু দেখা যায়, একপর্যায়ে এগুলো কোনো কাজ করতে পারছে না, ফলে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। ফলে বরকত, সালাম, জব্বার ও রফিকসহ নাম না জানা আরো অনেকেই নিহত হয়। ভাষা আন্দোলন সমর্থন করার ব্যাপারে মওলানা ভাসানী, জনাব আবুল হাসিম, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, খন্দকার মুশতাক আহমদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, জনাব অলি আহাদ, মাওলানা আব্দুর
রশিদ তর্কবাগীশ ও এম ওসমান আলী প্রমুখকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে আন্দোলনের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়।
৭. রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি : ভাষা আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন পরিষদের অধিবেশনেও চরম বাকবিতণ্ডা দেখা দেয়। এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিম উদ্দিন এবং নুরুল আমীন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। এ সময় মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন আইন পরিষদে তাঁর সদস্যপদ ত্যাগ করেন। দেশের সর্বত্র সরকারের ঘৃণ্য প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ধিক্কার ধ্বনি উত্থিত হয়। সে সাথে বাঙালিদের দাবি আদায়ের সংগ্রাম আরো দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায়। ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলার দেওয়ালে দেওয়ালে, পথঘাট প্রান্তরে যে রক্ত শপথের বীজ ছড়িয়ে পড়ে তার কাছে সরকারকে শেষপর্যন্ত নতি স্বীকার করতে হয়। প্রাদেশিক পরিষদে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করেন (এপ্রিল ১৯৫২)। অতএব বাংলা ভাষা উর্দু ভাষার পাশে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির মুখের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রত্যক্ষ আন্দোলন। বাঙালির মুখের ভাষা যাতে কেউ কেঁড়ে নিতে না পারে, সেজন্য প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল। আর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল বলে সফল হতে সক্ষম হয়।