‘অথবা, রামানুজ কর্তৃক শঙ্করের মায়াবাদ খণ্ডন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, কোন যুক্তির আলোকে রামানুজ শঙ্করের মায়াবাদ খণ্ডন করেন।
অথবা, রামানুজ কর্তৃক শঙ্করের মায়াবাদ খণ্ডনের কৌশল লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : মহর্ষি বাদরায়ন (আনু. ৫০০ খ্রি. পূ.) প্রণীত বেদান্তসূত্রে (৫৫৫টি সূত্র) ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিপাদিত হয়েছে বলে একে ব্রহ্মসূত্র বলে। আবার জীবের স্বরূপ বর্ণিত হওয়ায় একে শারীরিকসূত্রও বলা হয়। ব্রহ্মসূত্রের সাতটি ভাষ্যের মধ্যে শঙ্করের শঙ্করভাষ্য এবং রামানুজের শ্রীভাষ্য অন্যতম। নিম্নে প্রশ্নের আলোকে আমাদের আলোচ্য বিষয়আলোচনা করা হলো :
রামানুজ কর্তৃক শঙ্করের মায়াবাদ খণ্ডন : রামানুজ নিম্নোক্ত যুক্তির সাহায্যে শঙ্করের মায়াবাদ খণ্ডণ করেন।
প্রথমত, শঙ্করের মতে, মায়া সৎ ও নয়, আবার অসৎও নয়। কিন্তু রামানুজ বলেছেন, ব্যক্তি মাত্রই হয় সৎ হবে, না হয় অসৎ হবে। সৎ এবং অসৎ স্ববিরোধী। স্ববিরোধী দুটি গুণ কারো বেলায় একই সময়ে একই অর্থে সত্য হতে পারে না, আবার মিথ্যাও হতে পারে না। তাই যদি হয় মায়া সৎও নয় এবং অসৎও নয়। কিন্তু এটি কেমন করে হয়? অতএব মায়ার
স্বরূপ অসিদ্ধ। তাই একে স্বরূপ অনুপপত্তি বলা হয়।
দ্বিতীয়ত, শঙ্করের মতে, মায়া ব্রহ্মের এরকম শক্তি যা অবর্ণনীয়। এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে রামনুজ বলেছেন, মায়া যদি ব্রহ্মের শক্তি হয় তবে ব্রহ্মকে আশ্রয় করে মায়া অবস্থান করে। মায়া হলো অজ্ঞান স্বরূপ আর ব্রহ্ম হলো জ্ঞান স্বরূপ। ব্রহ্মে যদি মায়ার আশ্রয় হয় তবে ব্রহ্মের স্বরূপে ব্যাঘাত ঘটে এবং ব্রহ্ম আর সর্বজ্ঞ থাকে না। অতএব, জ্ঞান স্বরূপ ব্রহ্মে অজ্ঞান এখানে আশ্রয়ানুপপত্তি ঘটেছে। স্বরূপ য়ার আশ্রয়ের
তৃতীয়ত, শঙ্করের মতে, মায়া বা অবিদ্যা হলো অনাদি এবং অনন্ত। কিন্তু রামানুজের মতে, শঙ্কর ব্রহ্মের বাইরে মায়ারূপ কোন শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেছে এবং এতে শঙ্করের অদ্বৈতবাদ দ্বৈতবাদে পরিণত হয়েছে।
চতুর্থত, শঙ্কর বলেছেন, এ জগৎ মায়ারই সৃষ্টি এবং মায়া জীবকে আশ্রয় করে অবস্থান করে। কিন্তু রামানুজ বলেছেন, জীব যেহেতু মায়ার সৃষ্টি সেহেতু মায়া জীবকে আশ্রয় করে অবস্থান করতে পারে। কিন্তু জীব যদি মায়ার সৃষ্টি হয় তবে মায়া কারণ এবং জীব কার্য এবং কারণ কোন সময় কার্যের উপর নির্ভর করতে পারে না।
পঞ্চমত, শঙ্করের মতে, মায়া ব্রহ্মকে আবৃত করে রাখে। এর প্রেক্ষিতে রামানুজ বলেছেন, মায়া ব্রহ্মকে আবৃত করতে পারে না। ব্রহ্ম স্বয়ং প্রকাশ এবং চির প্রকাশমান। ব্রহ্মকে আবৃত্ত করা সম্ভব হলে ব্রহ্ম অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে।
ষষ্ঠত, শঙ্করের মতে, মায়া হলো অবিদ্যা বা অজ্ঞান । কিন্তু মায়া যদি অজ্ঞান বা অবিদ্যা হয় তবে ব্রহ্মকে লুকিয়ে রাখারূপ ক্রিয়া করে কেমন করে? কারণ অজ্ঞান বা অবিদ্যা জ্ঞানের অভাব বলে স্বীকৃত। আর অভাব পদার্থের কোন ক্রিয়া থাকা তো সম্ভব নয়।
সপ্তমত, তর্কের খাতিরে মায়াকে যদি বাস্তবও মনে করা হয় তবে ব্রহ্ম জ্ঞানে তা নষ্ট হয় কেমন করে? অস্তিত্বশীল কোন বস্তু তো জ্ঞানের দ্বারা বিনষ্ট হতে পারে না। রামানুজের মতে, মায়া ব্রহ্মের অচিৎশক্তি এবং ব্রহ্মের অংশ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, শঙ্কর নিজেও মায়া সম্পর্কে কোন বুদ্ধিগত ধারণার কথা বলেন নি। মায়া সম্পর্কে কোন ধারণা করা সম্ভব নয়। কারণ অনুরূপ বস্তু সম্পর্কে কোন প্রমাণ সম্ভব নয়। রামানুজ নিজেও বলেছেন, মায়া সম্পর্কে সম্ভাব্য কোন প্রমাণ সম্ভব নয়।