অথবা , ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজা বা রাণীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের রাজা বা রাণীর ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, রাজার (ইংল্যান্ড) তিনটি অধিকার রয়েছে- আলোচনা করার অধিকার উৎসহ দেবার অধিকার এবং সতর্ক করে দেবার অধিকার। “রাজার এসব অধিকারের তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন মহান ঐতিহ্যবাহী ও বংশানুক্রমিক প্রতিষ্ঠান ‘British Monarchy’, যা পঞ্চম শতাব্দীতে ‘Anglo Saxon’ এর সময়ে পূর্ণাঙ্গরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এক সময় রাজা বা রাণী ছিলেন Real Chief Executive। কিন্তু ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের মাধ্যমে রাজার কর্তৃত্ব, প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্বের স্থলে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাজশক্তি একটি ‘Constitutional institution’ এ রূপলাভ করে। এ প্রেক্ষাপটেই বলা হয়, “The King or Queen reigns, but does not govern.” তথাপিও বর্তমানে ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজশক্তি যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস। ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে রাজা বা রাণীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। Ivor Jennings বলেছেন, “The Monarchy is a useful instrument because it is personal and flexible, real and trangible.”
রাজা রাজত্ব করেন, শাসন করেন না: ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজা বা রাণী এক বিশিষ্ট পদমর্যাদার অধিকারী। তত্ত্বগতভাবে এরা বিপুল ক্ষমতার অধিকারী এবং আনুষ্ঠানিকভাবে তারা দেশের প্রধান। কিন্তু কার্যগত দিকের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ব্যক্তিগতভাবে রাজা বা রাণী এসব ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন না। নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে তারা ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীকে নিয়োগদান করে এবং বিভিন্ন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে থাকেন। তাই অনেকেই ব্রিটেনের রাজা বা রাণীর ক্ষমতা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, রাজা রাজত্ব করেন ঠিকই কিন্তু শাসন করতে পারেন না। উক্তিটি বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় রাজা বা রাণী যেসব ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন সে সম্পর্কে জানা। নিম্নে ব্রিটেনের রাজা বা রাণীর ক্ষমতা বা কার্যাবলি/আলোচনা করা হল:
১. শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলি: রাজশক্তি ব্রিটেনের সর্বোচ্চ শাসন কর্তৃপক্ষ। এ অর্থে তত্ত্বগতভাবে রাজা বা রাণী হলেন Chief Executive। নিক রাজা যা রাণী শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে যেসব ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পাদন করেন তা
আলোচনা করা হল।
ক. নিয়োগ সংক্রান্ত: প্রথমত রাজা বা রাণী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদান। করেন। তারপর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগদান করেন। অতঃপর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সর্বস্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগদান করেন। এছাড়া সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিগণও রাজার মাধ্যমে নিয়োগ লাভ করেন। রাজা বা রাণী Commonwealth এর প্রধান হিসেবে ডোমিনিয়নগুলোরও প্রধান। এ হিসেবে তিনি ডোমিনিয়নগুলোর ক্যাবিনেটের পরামর্শ অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করেন।
খ. আন্তর্জাতিক বিষয়ক ক্ষমতা: রাজা বা রাণী ব্রিটেনের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির রূপকার। রাষ্ট্রদূত প্রেরণ এবং অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের গ্রহণ এছাড়া রাজা বা রাণী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি, সন্ধি, শান্তিস্থাপন কিংবা প্রয়োজনে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন।
গ. সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক: রাজা বা রাণীর নিকট থেকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সকল কর্মকর্তা কমিশন লাভ করেন। সামরিক বাহিনী তাঁর নামে পরিচালিত হয়। তার নামে যুদ্ধ ঘোষণা ও শান্তি স্থাপন করা
হয়। সুতরাং দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলো তার নির্দেশে সংগঠিত হয়।
ঘ. শাসনকার্যের শূন্যতা পূরণ: ক্ষমতাসীন মন্ত্রিসভার মেয়াদ শেষ হলে নিয়মানুযায়ী মন্ত্রিসভাকে প্রস্থান করতে হয়। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রিসভা গঠন করে। এ প্রস্থান এবং নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্যবর্তী সময়ে শাসনকার্যে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা পূরণে রাজা বা রাণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।
ঙ. শাসনব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষা ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রবর্তিত নেই। এক্ষেত্রে শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপনে রাজা বা রাণী বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষ করে সরকারি দল ও বিরোধী দলের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। রাজা বা রাণী, উভয় দলের সাথে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করে থাকে।
২. আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা: ব্রিটেনের রাজা বা রাণী আইন বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকল প্রকার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে থাকলেও রাজা বা রাণী কতিপয় ক্ষমতা চর্চা করে থাকেন। নিম্নে আইন সংক্রান্ত রাজা বা রাণীর ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
ক. পার্লাসেন্ট সংক্রান্ত ক্ষমতা: পার্লামেন্টে অধিবেশন আহ্বান, মুলতবি এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কমপসভা ভেঙে দিতে পারেন। এজন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে বলা হয় ‘King or Queen in Parliament.”
খ. রাজকীয় অভিভাষণ প্রদান: প্রতি বছর পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনে রাজা বা রাণী একটি অভিভাষণ পাঠ করেন। যদিও এ ভাষণটি প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার নির্দেশে প্রণীত হয়, তথাপি উক্ত ভাষণে মূলত সরকারের নীতি ও
কার্যসমূহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
গ. আইন প্রণয়নের ক্ষমতা: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাজা বা রাণী শুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। রাজা বা রাণী তার ক্ষমতাবলে পার্লামেন্ট প্রণীত কোন বিলে স্বাক্ষর প্রদান করেন। কারণ রাজার সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনে পরিণত হয় না। রাজার সম্মতি বা স্বাক্ষর সাপেক্ষে পার্লামেন্ট গৃহীত কোন আইনের প্রস্তাব বিধিবদ্ধ আইনে পরিণত হয় এবং বাস্তবে বলবৎ হয়। তবে রাজা কোন বিলে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য না হলেও তিনি কোন বিলে অসম্মতি প্রদান করেন না।
৩. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা: ব্রিটেনের রাজা বা রাণীকে ন্যায়বিচারের উৎসরূপে গণ্য করা হয়। তাই ব্রিটেনের রাজা বা রাণী বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে Prof. Ogg and Zink বলেছেন, “The crown remains the historic fountain of justice and technically, the courts are still the kings courts.” নিম্নে ব্রিটেনের রাজা বা রাণীর বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলঃ
ক. বিচারপতি নিয়োগ: ব্রিটেনের রাজা বা রাণী বিভিন্ন আদালতে বিচারপতিদের নিয়োগদান করেন, আবার পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতিদের পদচ্যুত করতে পারেন। বিচারপতিদের কার্যাবলি, বেতন, পদচ্যুতি প্রভৃতি পার্লামেন্টে আইনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। সকল বিচারালয়ের তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ রাজার নামে লর্ড চ্যান্সেলর সম্পাদন করে থাকেন।
খ. উপনিবেশসমূহের আপিল মামলার বিচার রাজা বা রাণী ব্রিটিশ কাউন্সিলের বিচার বিভাগীয় কমিটির পরামর্শক্রমে কমনওয়েলথভুক্ত কয়েকটি দেশ ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশগুলোর আদালত থেকে আসা আপিল মামলার বিচার করেন। অবশ্য বর্তমানে অধিকাংশ কমনওয়েলথভুক্ত জোট ব্রিটিশ কাউন্সিলে আপিল বিচারের ব্যাখ্যা তুলে দিয়েছে।
গ. আদালতে অভিযোগ পেশ: ব্রিটেনের সকল ফৌজদারি মামলা রাজশক্তির নামে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ সকল ফৌজদারি মামলায় স্বয়ং রাজা বা রাণী হলেন ফরিয়াদি পক্ষ। ফরিয়াদির পক্ষে রাজা বা রাণী মামলা পরিচালনার সকল দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
ঘ. ক্ষমা প্রদর্শন: ব্রিটেনের রাজা বা রাণী দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড হ্রাস করতে পারেন অথবা বিশেষ ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেন।
৪. ঐতিহ্যগত ক্ষমতা: রাজা সর্বশ্রেষ্ঠ সামন্ত হিসেবে সাধারণ ও অসাধারণ উপায়ে রাজস্ব আদায় করতে পারেন। এটিও তাঁর চরম অধিকার। তাই রাজাকেও গুপ্তধনের অধিপতি বলা হয়। শান্তিকালীন কোন উন্নয়নকালে বা বিপদকালে তিনি এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
৫. ধর্মীয় ক্ষমতা: রাজা বা রাণী ব্রিটেনের খ্রিস্টধর্মের প্রধান। বলা হয় “The king is the head of the church
of England.” ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি Archbishops, Bishops এবং Church-দের নিয়োগদান করেন। রাজা বা রাণীর নির্দেশক্রমেই খ্রিস্টধর্মের প্রতিষ্ঠানগুলোর সভা অনুষ্ঠিত হয়। চার্চের বিধিবিধানসমূহ রাজা বা রাণীর অনুমোদন সাপেক্ষ।
৬. সম্মান বিতরণ সংক্রান্ত ক্ষমতা: বলা হয়ে থাকে যে, “The king is the sole foundation of honour.” রাজা বা রাণী প্রীতিভাজক ব্যক্তিদের সম্মানসূচক পদক, সম্মানসূচক উপাধি প্রদান করেন। রাজা বা রাণীর জন্মদিন, নববর্ষ, রাজ্যাভিষেক প্রভৃতি আনন্দঘন অনুষ্ঠানে এসব সম্মান ও উপাধি বিতরণ করা হয়।
৭. বিরোধ নিষ্পত্তি: বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে কোন কারণে বিরোধ কিংবা সংঘর্ষ বাধলে নিরপেক্ষ চরিত্রবিশিষ্ট রাজা বা রাণীর পলিসি সংশ্লিষ্ট সব পথই মেনে নিতে সাধারণত কোন আপত্তি করে না। ফলে বিরোধের সন্তোষজনক নিষ্পত্তি সম্ভব। হয়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভাই প্রকৃত শাসন। কর্তৃপক্ষ। তবুও রাজা বা রাণী ক্ষেত্রবিশেষে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুসারে কাজ করতে পারেন। K. C. Wheare বলেছেন, “It would be incorrect to suppose that because the queen occupies a strictly constitutional role she is therefore a puppet monarch.” আবার Ivor Jennings বলেছেন, “ব্রিটেনের রাজা বা রাণীর প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। যদিও রাজার সকল কাজেই পার্লামেন্টের অনুমোদন প্রয়োজন, তবুও তার কার্যাবলির গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।”