অথবা, “আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই যাকে অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি”- এ উক্তির আলোকে কাজী নজরুল ইসলামের আত্মবিশ্বাসের যে প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় লেখ।
উত্তরঃ ভূমিকা : বিদ্রোহী প্রাবন্ধিক কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রবন্ধে গভীর আত্মবিশ্বাসী রাজদ্রোহীর যে পরিচয় ফুটে উঠেছে তা প্রকৃত অর্থেই অনুপম ও অবিস্মরণীয়। রাজদ্রোহীর সুদৃঢ় বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কবির সমাজ তথা দেশ-সচেতনতা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
রাজশক্তির মুখোস : যুগে যুগে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী কন্ঠ উচ্চারিত না হলে মানব সমাজ শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়নের পেষণে বিচূর্ণ ও বিপর্যস্ত হয়ে যেত। তছনছ হয়ে যেত সমাজ তথা সভ্যতার মূল্যবোধ। ভেঙে পড়ত সমাজব্যবস্থা। কেননা শোষক, শাসক, নিপীড়কেরা শুধু নিজেদের স্বার্থই ভালো বুঝে। আর সে স্বার্থ উদ্ধার করতে যে কোন স্বেচ্ছাচার বা অপকর্ম করতে তারা দ্বিধা করে না। এ জন্য যে কোন ধরনের কুটকৌশলের আশ্রয় নিতেও তাদের বিবেকের দংশন সহ্য করতে হয় না। কেননা মানবিক বিবেচনা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। শোষক শাসকেরা ন্যায় সত্য সুন্দরের দরজা বন্ধ করে রাখে। মানবিক মূল্যবোধের ন্যাকামি তাদের চরিত্রের খোলস মাত্র।
বিচারের স্বরূপ : শাসকগোষ্ঠীর খোলসের পরিচয় পেয়েছেন কবি। তিনি বিস্তর শুনেছেন, জেনেছেন এবং দেখেছেন। বিভিন্ন বিভাগে নিয়োজিত ব্যক্তিরা তাদের রাজকর্মচারী রাজন্যবর্গের অধীন। সুতরাং, রাজার নির্দেশ পালন করতে বিচারক বাধ্য। এজন্য কবি নির্দ্বিধায় বলতে পেয়েছেন, “সে সত্যের নয়, সে রাজার। সে ন্যায়ের নয়, সে আইনের। সে স্বাধীন নয়, সে রাজভৃত্য।”
চিরন্তন মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস : চিরন্তন মূল্যবোধের প্রতি অনুরাগী কবি তাই সত্যকে সত্য বলেছেন, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন অকপটে। তাঁর বুদ্ধি বিবেক যা সত্য বলে ভেবেছেন কবি তার প্রতিই অনুগত থেকেছেন। যা ন্যায় ও কল্যাণকর মনে করেছেন তাই লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। তিনি মিথ্যা বা ভুল কিছু বলেননি বা লেখেননি। তাঁর বাণী আপামর মানুষের জন্য কল্যাণৰাণী। কবি দৃঢ়চিত্তে বলেছেন, “সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যাবিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যস্রোহী নয়।”
রাজদ্রোহের স্বরূপ : পরাধীন মানুষের মুক্তির জন্য যাঁরা কাজ করেন, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যাঁরা আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা পিছপা হন না। কেননা তাঁরা জানেন, তাঁরা যা করছেন তা সঠিক-নির্ভুল। অধিকাংশ মানুষের স্বার্থই তাঁদের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়। কবি নিজেও মনে করেন, তিনি সত্য প্রকাশের যন্ত্র। ন্যায় ও সত্যের পক্ষ অবলম্বন করে অনেক রাজবিদ্রোহী মরেছে। আবার অন্যায় অসত্যকে ধারণ করে অনেক অবিচারী রাজাও মরেছে। মৃত্যু যখন অনিবার্য, তখন সত্য-সুন্দরের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে আপত্তি কি। সত্য বাণীর মৃত্যু হয় না, তা অন্যের কন্ঠে উচ্চারিত হয়। তাই বাঁশি কেড়ে নিলেই সুরের মৃত্যু হয় না- সুর তো চিরন্তন। সত্যকে বুকে ধারণ করেই কবি উচ্চারণ করেন, “যে বাঁশি আমার কণ্ঠ দিয়ে নির্গত হয়েছে, তার জন্য দায়ী আমি নই। দোষ আমারও নয়, আমার বীণারও নয়; দোষ তাঁর, যিনি আমার কণ্ঠে তাঁর বীণা বাজান।”
বিচারকের দৃষ্টি : কবি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন- “রাজ নিযুক্ত বিচারক সত্য বিচারক হতে পারে না।” এটা বিচার নামের প্রহসন। এ কারণে অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ।” এটা ন্যায়ের নামে বিভ্রান্তি। সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো— শাসক শোষকের স্বেচ্ছাচারী প্রক্রিয়া। কবি নিজেও এ অবস্থার নির্মম শিকার। তিনি সচেতন মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, “এই অন
্যায় শাসন-ক্লিষ্ট বন্দী সত্যের পীড়িত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই কি আমি রাজদ্রোহী?”
রাজদ্রোহীর দৃষ্টিভঙ্গি : ‘আমার আত্মা সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা’- নিজের প্রতি কতটা আস্থা এবং বিশ্বাস থাকলে একথা স্বচ্ছন্দে উচ্চরণ করা যায়। নিজের ভাবনাকে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে, নিজের আদর্শকে, নিজের আত্মাকে বিশ্বাস করলেই কেবল এমন মন্তব্য দৃঢ়চিত্তে উচ্চারণ করা যায়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভারতবাসীর পরম কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি শুধু রাজার সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেননি, সমাজের জাতির যা কিছু সংকীর্ণতা ও আড়ষ্টতা তার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁর স্বচ্ছতা ছিল বলেই তিনি তা অকপট চিত্তে লিখতে পেরেছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, “কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসা এবং প্রসাদের লোভে কাহারো পিছনে পো ধরি নাই।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায় যে, কবি অন্ধ বিশ্বাসে, লাভের লোভে, রাজভয় বা লোকভয়ে মিথ্যাকে কোনক্রমেই স্বীকার করেননি। নিজের বিবেক বা আত্মার কাছে অভিযুক্ত বা অপরাধী হতে তিনি রাজি ছিলেন না। তাই নির্দ্বিধায় অন্যায়কে অন্যায় বলেছেন, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছেন। নিজ উপলব্ধিকে কোন কিছুর বিনিময়েই বিসর্জন দেননি। তাই কবি সুদৃঢ় চিত্তে বলেছেন, “এ আমার অহংকার নয়, আত্মোপলব্ধির, আত্মবিশ্বাসের চেতনালব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি।”