রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের কার্যাবলি আলোচনা কর।

অথবা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের ভূমিকা আলোচনা কর।
অথবা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের কী কী কাজ রয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, রাষ্ট্রের কার্যাবলি বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানে যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তার মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অন্যতম। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বৃহত্তর সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক আচার আচরণ, গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্য, আমলাতন্ত্র, সিভিল সমাজ, রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা না থাকলে সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় মজবুত ভিত্তি গড়ে উঠে না। কেননা এগুলো হচ্ছে সমাজের অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমেই সমাজজীবন সুন্দর স্থিতিশীল অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয় ।
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের কার্যাবলি : নিম্নে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের কার্যাবলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. রাষ্ট্র একটি সীমিত সংস্থা : ম্যাকাইভার তাঁর ‘The Modern State’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের কার্যাবলি প্রসঙ্গে বলেছেন, রাষ্ট্র সর্বজনীন হলেও এটি একটি সীমিত সংস্থা। রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতার পিছনে রয়েছে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রথা, পদ্ধতি, প্রতিরোধের ভয় এবং সমাজের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের সংঘের অস্তিত্ব। তাঁর মতে, রাষ্ট্র যেসব সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করে সেসব অন্য সংগঠনের দ্বারা সম্ভব নয় ।
২. সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে : রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের এমন কতকগুলো যোগ্যতা লক্ষ্য করা যায়, যা সমাজের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোয় দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকল্পে রাষ্ট্র গোটা দেশকে একটি সাংবিধানিক আওতায় এনে বিভিন্ন ধরনের শিল্প, কলকারখানা প্রভৃতি গড়ে তোলে এবং আইনকানুন প্রণয়নের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করে।
৩. শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা : সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ। দেশের সাধারণ মানুষ যাতে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে সেজন্য রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন, সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং শাস্তির বিধান করে থাকে । মোটকথা রাষ্ট্র হচ্ছে জনস্বার্থের জামিনদার এবং অভিভাবক। কিন্তু রাষ্ট্রের এ ক্ষমতা তার নিজের জন্য নয়, সমাজ সংরক্ষণ ও বিকাশের স্বার্থে রাষ্ট্র এটি প্রয়োগ করে।
৪. প্রথা পদ্ধতি ও রীতিনীতির উপর হস্তক্ষেপ না করা : সামাজিক জীবনে মানুষের এমন কতকগুলো প্রথা পদ্ধতি থাকে, যা রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহির্ভূত বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন- সামাজিক প্রথা, লোকনীতি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি। মোটকথা রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক প্রথা পদ্ধতির উপর কোন হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ যে কোন সামাজিক প্রথা, রীতিনীতির সৃজনে রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা নেই।
৫. সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধন : সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের কার্যাবলির মধ্যে মানুষের কর্মদক্ষতার বিকাশ ও সংরক্ষণের সাথে অর্থনৈতিক সম্পদের যোগসূত্র স্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রই বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বার্থে দেশের অন্য সকল. সম্পদের সাথে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারী। তবে এ অধিকার যদি কতিপয় ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত হয়, তাহলে সমগ্র সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধন হতে পারে।
৬. জনমত নিয়ন্ত্রণ না করা : ম্যাকাইভারের মতে, রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা রাষ্ট্রের দ্বারা স্বীকৃত। কিন্তু যদি তা রাষ্ট্রের অস ্তিত্ব বিপন্ন করার কাজে ব্যবহৃত হয় তখন রাষ্ট্র তা বন্ধের জন্য বলপ্রয়োগ করতে পারে।
৭. সার্বভৌমত্ব রক্ষা : রাষ্ট্র সমাজের সার্বভৌম শক্তির আধার ও প্রতীক। রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। কারণ এটি না থাকলে রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব হারাবে। সার্বভৌমত্বের দুটি দিক আছে। একটি অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, অন্যটি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা। বস্তুত রাষ্ট্রকে দেশের অভ্যন্তরে যেমন শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে, তেমনি যাতে বহিঃশত্রুরা আক্রমণ করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
৮. জনকল্যাণকর কাজ : রাষ্ট্র হচ্ছে জনস্বার্থের জামিনদার এবং অভিভাবক। এজন্য রাষ্ট্র সমাজস্থ মানুষের উপকারার্থে কল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে। যথা : খাল খনন, সেচ সুবিধা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতি ।
৯. নৈতিকতা আরোপ : রাষ্ট্র নৈতিকতার কোন মানদণ্ড আরোপ করতে পারে না। নৈতিকতার ক্ষেত্র রাজনৈতিক আইন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। নৈতিকতা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা বলতে কোনকিছু নেই। ব্যক্তিগত নৈতিকতা ভিন্ন অন্য কিছুর অস্তিত্ব অকল্পনীয়। এজন্য রাষ্ট্রের আইন কোন ধরনের সামাজিক নৈতিকতা অনুমোদন করতে পারে না।
১০. রাষ্ট্র সংস্কৃতি জন্ম দেয় না : সংস্কৃতি একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কিংবা একটি যুগের মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। অতএব সংস্কৃতির সৃজন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। ম্যাকাইভার বলেছেন, “সংস্কৃতি হলো কর্মকাণ্ডের ফসল, যা অভ্যন্তরীণ শক্তি দ্বারা সংরক্ষিত হয়, এখানে রাজনৈতিক আইনের তথা রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা নেই।”
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্র একটি অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ ও বাইরের আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করাই হলো রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। সময় ও সমাজভেদে বিভিন্ন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও কার্যাবলির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মোটকথা যদিও রাষ্ট্র সব রকম সামাজিক কার্যসম্পাদনের উপযোগী প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নয়, তথাপিও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের গুরুত্ব অপরিসীম।