রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।

রকেট সাজেশন
রকেট সাজেশন

অথবা, রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর তুলনামূলক আলোচনা কর।
অথবা, রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর বৈসাদৃশ্যসমূহ আলোচনা কর। অথবা, রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে বৈপরীত্য উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা : রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী উভয়ই দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হলেও তাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অধ্যাপক বল ( Alan R. Ball) অধ্যাপক নিউম্যান প্রমুখ আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যের কথা বলেছেন। উৎপত্তি, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি প্রভুতির পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখা যায় ।

রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য (Difference between political party and interest groups): রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী উভয়ই দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীভূত হলেও তাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অধ্যাপক বল (Alan R. Ball), অধ্যাপক নিউম্যান (Neuman) প্রমুখ আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাজনৈতিক দল ও চাপমুক্তিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যের কথা বলেছেন। উৎপত্তি, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়। নিম্নে রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যকার পার্থক্যসমূহ আলোচনা করা হলো।

১. উদ্দেশ্যগত পার্থক্য : সাধারণত বহুমুখী ও ব্যাপক সামাজিক বা জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণই হলো রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য। রাজনৈতিক দল সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থকে গুরুত্ব দেয় না। দল সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করতে চায়।কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সামনে বৃহত্তর জাতীয় কল্যাণসাধনের কোন মহান উদ্দেশ্য থাকে না। সংকীর্ণ ও সমজাতীয় বিশেষ গোষ্ঠীগত স্বার্থকে কেন্দ্র করে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উৎপত্তি হয়।

২. উৎপত্তিগত পার্থক্য : সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে। এ মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় নীতি ও ব্যাপক কর্মসূচি রচিত হয় এবং তা বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করা হয়। পক্ষান্তরে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উৎপত্তির ভিত্তিতে কোন বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না।

৩. নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে পার্থক্য : প্রতিটি রাজনৈতিক দল দলীয় প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরাসরি অবতীর্ণ হয়।কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না। তবে এ গোষ্ঠীগুলো গোষ্ঠীস্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে কোন দল বা প্রার্থীকে সমর্থন এবং তার পক্ষে প্রচার করতে পারে।

৪. সাংগঠনিক পার্থক্য : বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কঠোর দলীয় শৃঙ্খলার ভিত্তিতে দলীয় সংহতি বজায় রাখার ব্যবস্থা থাকায় রাজনৈতিক দল অনেক বেশি সুসংগঠিত।অপরদিকে, সাংগঠনিক দিক থেকে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক দল অপেক্ষা দুর্বল।

৫. সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পার্থক্য : কর্মপদ্ধতির প্রকৃতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে
পার্থক্য বর্তমান। অভিন্ন গোষ্ঠীস্বার্থের অস্তিত্ব হেতু স্বার্থগোষ্ঠী যে কোন বিষয়ে সহজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। অপরদিকে, স্বাভাবিক কারণে রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজে সম্ভব নয়।

৬. সমঝোতাগত পার্থক্য : প্রয়োজনবোধে নির্দিষ্ট স্বার্থের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। বহুদলীয় ব্যবস্থায় সমভাবাপন্ন দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মোর্চা নিতান্তই স্বাভাবিক। কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিভূ স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এ ধরনের সমঝোতা বড় একটা দেখা যায় না।

৭. প্রত্যক্ষ ও প্রকাশ্য পার্থক্য: রাজনৈতিক দলের কর্মপদ্ধতি প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ। জনসাধারণ রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে অবহিত থাকে।কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপ পরোক্ষভাবে ও গোপনে সম্পাদিত হয়।

৮. সংহতি প্রশ্নে পার্থক্য : একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর লোক থাকতে পারে, এর ফলে দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সংহতির প্রশ্ন বড় করে দেখা দেয়।কিন্তু স্বার্থগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সংহতির সমস্যা বড় একটা দেখা যায় না।

৯. অপরিহার্যতাপত: উদারনৈতিক, সর্বাত্মক, সমাজতান্ত্রিক নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। কিন্তু একথা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বার্থগোষ্ঠী থাকে না।সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্বার্থগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।

১০. পৃষ্ঠপোষকতাগত পার্থক্য : সাধারণভাবে রাজনৈতিক দলই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবক, মহিলা সংগঠন গড়ে উঠে ।আবার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীও রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে পারে। ঊনবিংশ শতকে ভারতীয় জাতীয় বৎসাস একটি রাজনৈতিক মঞ্চরূপে গঠিত হয়। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীরূপেই তার উদ্ভব। প্রথমাবস্থায় মুসলিম লীগও এ ধরনের একটি গোষ্ঠী ছিল।

১১. ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে পার্থক্য: রাজনৈতিক দল নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী। অপরদিকে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রধান উদ্দেশ্য ক্ষমতা দখল নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হলো সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার করা।

১২. পেশাগত পার্থক্য : রাজনৈতিক দলে বিভিন্ন পেশার লোকের সমাবেশ ঘটে।
অপরদিকে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ এক একটি পেশার ভিত্তিতে গড়ে উঠে।

১৩. লক্ষ্যগত পার্থক্য : উদ্দেশ্যগত বিচারে রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য বহুমুখী ও ব্যাপক হলেও সরকারি ক্ষমতা দখল করে দলীয় নীতি ও কর্মসূচিকে বাস্তবে রূপায়িত করাই হলো দলের মূল লক্ষ্য কিন্তু চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সরকারি সিদ্ধান্তকে গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করাই একমাত্র উদ্দেশ্য।

১৪. সদস্য সংখ্যাগত পার্থক্য : সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর তুলনায় রাজনৈতিক দলের সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি। তবে সবক্ষেত্রেই এ ধারণা প্রযোজ্য নয়। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়, আঞ্চলিক কোন ছোট দলের তুলনায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি থাকে।

১৫. আদর্শগত পার্থক্য : রাজনৈতিক দলের আদর্শ ব্যাপক, এর একটি নির্দিষ্ট আদর্শ থাকে এবং সে আদর্শকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলের কর্মকাও নির্ধারিত হয়। অপরদিকে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর নিজস্ব কোন আদর্শ নেই। এটি সময় ও সুযোগমতো অন্যের আদর্শ অনুসরণ করে।

১৬. সরকার গঠন সচলন্ত পার্থক্য: রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হলো নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন কর তাদের নির্বাচিত করার প্রচেষ্টা করা, নির্বাচনের পর সরকার গঠন করা, এছাড়া পরবর্তী নির্বাচনে কিভাবে সাফল্য অর্জ করা যায় তার চেষ্টা করা। অপরদিকে, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কর্তব্য হলো নিজেদের স্বার্থকে বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা। তারা সরকারি ক্ষমতা দখল করতে চায় না, নিজেদের কর্মসূচি বা স্বার্থকে সরকারি নীতির অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী উভয়ের উপস্থিতি একান্ত কাম্য। রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পার্থক্য সর্বদা স্পষ্ট নয়। উৎপত্তি, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও তাদের উদ্দেশ্য হলো দেশ ও জাতির কল্যাণসাধন করা। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর মধ্যে মৌলিক বিষয়ে অনেক মিল পরিলক্ষিত হয়