উত্তরঃ ‘ঐকতান’ শীর্ষক কবিতায় রবীন্দ্রনাথের বহু বিচিত্র ও অত্যাশ্চর্য বিষয় ধরা দিয়েছে। কবি সময় জনগোষ্ঠীকে কাব্যে স্থান দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। অপরদিকে কবি তাঁর জীবনদৃষ্টি অধ্যয়নের মাধ্যমে পূর্ণ করেছেন। তাই ‘ঐকতান’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তরের পরিচয়সমৃদ্ধ অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। ‘ঐকতান’ কবিতাটি কবির মৃত্যুর বছরই ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কবি যখন তাঁর কাব্যকীর্তির মূল্যায়নে ব্রতী হলেন তখনই তাঁর দুর্বল দিকগুলো ধরা পড়ল। তাঁর কাব্যে সমগ্র জনগোষ্ঠী অনুপস্থিত। তাঁর কাব্যে ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের যত আলোচনা হয়েছে সমগ্র বাঙালিকে ততখানি ধারণ করা যায়নি। এ জন্য ‘ঐকতান’ কবিতায় কবির অতৃপ্তির বেদনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্র মানুষ বিরাজমান। ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে বিশ্বলোকে মানুষ একাকার হয়ে আছে। কবি সমগ্র বিশ্বকে জয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতার কারণে তাঁর পক্ষে জয় করা সম্ভব হয়নি। এমনকি বিশ্বসাহিত্যের দরবারে আত্মসংযোগ করাও সম্ভব হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঐকতান’ কবিতার মূলবক্তব্য:
কবির আত্ম-সমালোচনা:
‘ঐকতান’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের কাব্য সাধনার অসম্পূর্ণতার জন্য আত্ম-সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, তার কবিতা বিচিত্র পথে অগ্রসর হলেও জীবনের সব স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। তিনি সকলের সাথে ঐক্য স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ব্যর্থতার কারণ: কবি নিজের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন:
জ্ঞানের দীনতা: কবি মনে করেন, তার জ্ঞান অসম্পূর্ণ। তিনি বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও গ্রন্থের জ্ঞানকে ভিক্ষালব্ধ ধনের মতো সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু তার জ্ঞানের গভীরতা নেই।
সমাজের উচ্চ মঞ্চ: কবি সমাজের উচ্চ স্তরে অবস্থান করার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি।
কৃত্রিমতা: কবি মনে করেন, তার কবিতা কৃত্রিমতায় ভরা। তিনি বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন।
কবির আকাঙ্ক্ষা: কবি এমন একজন কবির আবির্ভাব কামনা করেন যিনি শ্রমজীবী মানুষের অংশীদার হয়ে সত্য ও কর্মের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে পারবেন।
মূলবক্তব্য: ‘ঐকতান’ কবিতা একজন সৃজনশীল মানুষের আত্ম-সমালোচনার অসাধারণ নিদর্শন। কবিতাটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আমাদের নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত এবং নিরন্তর উন্নতির চেষ্টা করা উচিত।
নবীন কবিদের প্রতি আহ্বান : কবি জীবনে যা করতে পারেননি- নবীন কবিদের প্রতি তা করার আহ্বান জানিয়েছেন। মাঝি তাঁতী, কৃষক, কামার যেন তাদের সাহিত্যে উঠে আসে। তাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না যেন সাহিত্যে রূপায়ণ হয়ে উঠে। এ কামনায় বিভোর হয়ে তিনি উচ্চারণ করেছেন-
(i) এসো কবি অখ্যাতজনের নির্বাক মনের;
মর্মের বেদনা যত করিয়ো উদ্ধার।
(ii) যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।
উপসংহার: ‘ঐকতান’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। কবিতাটি আমাদের জীবনে অনুপ্রেরণা ও শিক্ষা দান করে। কবি নিজের কাব্য সাধনার অসম্পূর্ণতার জন্য আত্ম-সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, তার কবিতা সকলের সাথে ঐক্য স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে।