যৌতুক প্রথার প্রতিকার আলোচনা কর।
অথবা, যৌতুক প্রথার প্রতিকারের উপায়সমূহ আলোচনা কর।
অথবা, কীভাবে যৌতুক প্রথার প্রতিকার করা যায় বর্ণনা কর।
অথবা, কী কী পদক্ষেপের মাধ্যমে যৌতুক প্রথা রোধ করা সম্ভব? আলোচনা কর।
উত্তর ভূমিকা : আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই নারী। কোন জনগোষ্ঠী উন্নয়নের পথে কতটা এগিয়েছে তার একটি অন্যতম নির্দেশক হলো সেখানকার নারীদের অবস্থানগত তারতম্য। বাংলাদেশের নারীরা পূর্বের
তুলনায় উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে। আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্যতার সাথে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু এখনও কিছু কিছু সামাজিক কুপ্রথা নারী সমাজকে আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে। নারী
নির্যাতনের ক্ষেত্রেও এগুলো বড় হাতিয়ার। যৌতুক হচ্ছে তেমনি একটি সামাজিক কুপ্রথা। যৌতুক প্রথা কোথাও কোথাও সরাসরি আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছদ্মাবরণে সমাজে টিকে আছে। যৌতুকের কারণেই নির্যাতিত হচ্ছে নারী
সমাজের একটি বড় অংশ। যৌতুক প্রথার প্রতিকার : যৌতুক একটি জটিল সামাজিক কুপ্রথা। এর শিকড় প্রোথিত সমাজের গভীরে।
তাই একদিনে এর প্রতিকার করা সম্ভব নয়। তবে নিম্নোক্ত উপায়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে ধীরে ধীরে এ ঘৃণ্য প্রথার প্রতিকার করা যায় :
১. সামাজিক সচেতনতা (Develop social consiciousness) : যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য সমাজের বিবেকবান ব্যক্তিরা (পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে)
সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে তাদের মতামত তুলে ধরতে পারেন। বিভিন্ন স্তরের মহিলাকে তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করতে হলে তাদের মধ্যে উপযোগী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
২. মহিলাদের অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান ( Assurance to preserve the right of women): সমাজ ও পরিবারের পুরুষের মতো নারীদের সমমর্যাদা ও সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে কনে পক্ষের উপর বর পক্ষের
যৌতুক চাহিদা কমে যাবে। গ্রাম ও শহর এলাকার সর্বস্তরের মহিলাকে তাদের আইনগত অধিকার সম্পর্কে অবহিত করা প্রয়োজন। ১৯৮০ সালে প্রণীত যৌতুক বিরোধী আইনে (Dowry prohibition Act, 1980) বলা হয়েছে যৌতুক দেওয়া
ও নেওয়া সামাজিক অপরাধ। এ অপরাধের কারণে অপরাধীকে ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত জেল এবং পাঁচহাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে।
৩. সামাজিক বয়কট (Boycott socially) : যৌতুক মোকাবিলা করতে হবে সামাজিকভাবে। যে ব্যক্তি যৌতুকয়নেবেন বা দেবেন তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। দাবি করে যৌতুক নেওয়া এবং দাবি ছাড়া যৌতুক
নেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিছু ক্ষেত্রে অধিক অর্থ উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যেমন কোনো কোনো ডাক্তার, প্রকৌশলী, বা কারিগর জোরালোভাবে যৌতুকের দাবি করেন যা এক ধরনের বিকৃত মানসিকতারই পরিচয় দেয়। ধূর্ত
লোকেরা যৌতুকের কথা সরাসরি না বলে বিভিন্ন ছলের আশ্রয় নেয়। যে নামেই দেওয়া হোক, যৌতুক লোভী শোষকদের যৌতুকের লোভ সংবরণ হয় না, বরং তা বাড়তেই থাকে। তাই এসব মেরুদণ্ডহীন শোষকদের বয়কট
করা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।
৪. মহিলাদের কর্মসংস্থান (Employment for women) : সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের (Employment & Empowerment) যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। যেহেতু যৌতুকের অন্যতম কারণ হচ্ছে, পুরুষের উপর নারীর নির্ভরশীলতা। দেখা যায়, বিয়ের পরে নারীর কাজ বা চাকরি করার সুযোগ থাকলে বিয়ের সময় বরপক্ষ সাধারণত যৌতুকের দাবি করে না।
৫. যৌতুক বিরোধী আন্দোলন (Movement against dowry) : আইনের কঠোর প্রয়োগের সাথে সাথে যৌতুক প্রথা বন্ধে সারাদেশে যৌতুক বিরোধী কার্যকর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মহিলা সংগঠনসমূহ, সরকারি ও
বেসরকারি সংগঠন সংস্থার সমবেত সচেতন উদ্যোগেই আন্দোলনের ধারা সূচিত হতে পারে। এছাড়া দেশের প্রতিটি পাড়া মহল্লায় যৌতুক এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, দিনদিন দেশে যৌতুকের প্রবণতা বাড়ছে। যৌতুক সংক্রান্ত নারী নির্যাতনের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। যৌতুক এ মুহূর্তে এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। অথচ ইউএনডিপি’র (UNDP) এক
গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও এ অঞ্চলে যৌতুক ছিল না। কিন্তু এখন, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে যৌতুক ছাড়া কোন বিয়েই হয় না। দাবিকৃত যৌতুক দিতে ব্যর্থতার মানেই হলো শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। প্রচলিত সামাজিক প্রথার কারণে ‘কন্যা দায়গ্রস্ত’ মা বাবা মেয়েদের বিয়ে দেন যৌতুকের বিনিময়ে। যৌতুক দূর করতে হলে সর্বাগ্রে নারীদের শিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।