যোগদর্শনে ঈশ্বরের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, যোগ ঈশ্বরতত্ত্ব আলোচনা কর।
অথবা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে যোগদর্শনের যুক্তিগুলো লিখ।
অথবা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে যোগদর্শনের যুক্তিগুলো কী কী?
অথবা, ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে যোগদর্শনের যুক্তিগুলো সংক্ষেপে লিখ।
উত্তর৷৷ ভূমিকা :
মহর্ষি পতঞ্জলি যোগদর্শনের প্রবর্তক এবং প্রতিষ্ঠাতা। মহর্ষি পতঞ্জলির নামানুসারে এ দর্শনের নাম পাতঞ্জল দর্শন। পাতঞ্জল দর্শনকে সাংখ্য প্রবচন নামেও অভিহিত করা হয়। তার কারণ মহর্ষি পতঞ্জলি কপিল মুনি প্রবর্তিত সাংখ্যমত স্বীকার করে সাংখ্য প্রবর্তিত পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব; যথা : পুরুষ, প্রকৃতি, মহত্তত্ত্ব, অহংকার, পঞ্চতন্মাত্র,
একাদশ ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চ মহাভূত স্বীকার করেছেন। পূর্বোক্ত পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব ছাড়া আরো একটি তত্ত্ব পাতঞ্জল দর্শনে স্বীকৃত হয়েছে। এ তত্ত্বটি হলো ঈশ্বর তত্ত্ব। এ কারণে পাতঞ্জল দর্শনের অপর নাম ‘সেশ্বর-সাংখ্য।’
ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে যোগদর্শনের যুক্তি : যোগদর্শন মতে, ঈশ্বর পরম গুরু। এমনকি তিনি মুক্ত পুরুষদেরও গুরু । যোগ দার্শনিকগণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য যে সকল যুক্তির অবতারণা করেছেন তা নিম্নরূপ :
১. বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি শাস্ত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট উক্তি আছে। এই সকল শাস্ত্রে ঈশ্বরকে পরমাত্মা, পরম পুরুষ,
চরম সত্তা ও জ্ঞানকর্তারূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি শাস্ত্র অভ্রান্ত। কাজেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতেই হবে।
যোগ শাস্ত্রকার ব্যাসদেব বলেন, বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি শাস্ত্রের মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরকে জানলেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব বেদের পূর্ববর্তী ।
২. যে সকল পদার্থের মাত্রাভেদ আছে তাদের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন স্তর থাকবেই। যেমন- আয়তনের দিক হতে পরমাণু ক্ষুদ্রতম এবং আকাশ বৃহত্তম। জ্ঞান এবং শক্তিরও মাত্রাভেদ আছে, অর্থাৎ কারো বেশি এবং কারো তার তুলনায় কম। কাজে এমন কোন পুরুষ আছেন যাঁর জ্ঞান ও শক্তি সর্বোচ্চ সীমায়, অর্থাৎ যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। মানুষের জ্ঞান ও শক্তি সীমাবদ্ধ, কারণ মানুষ সসীম জীব। কাজেই সেই সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান পুরুষ ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ নন। কাজেই ঈশ্বর আছেন।
৩. যোগ শাস্ত্রকারেরা বলেন, প্রকৃতি-পুরুষের সংযোগের ফলে জগতের অভিব্যক্তি এবং বিয়োগের ফলে জগতের বিনাশ হয়। কিন্তু প্রকৃতি এবং পুরুষ বিরুদ্ধধর্মী। যেমন- প্রকৃতি সক্রিয় আর পুরুষ নিষ্ক্রিয়। প্রকৃতি অচেতন আর পুরুষ সচেতন ইত্যাদি। প্রকৃতি এবং পুরুষ বিরুদ্ধধর্মী বলে তাদের সংযোগ বা বিয়োগ তাদের স্বাভাবিক ধর্ম হতে পারে না। যোগশাস্ত্রকারেরা বলেন, কোন একজন সচেতন সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ পুরুষের সাহায্যে এই সংযোগ বা বিয়োগ সম্ভব হয়েছে। এই সংযোগ বা বিয়োগ সাধনকারী পুরুষই হলেন ঈশ্বর। কাজেই ঈশ্বর আছেন।
জীব তার অদৃষ্ট অনুসারে জন্ম-মৃত্যুর অধীন হয়। কিন্তু জীব সীমিত বলে তার নিজের অদৃষ্ট সম্পর্কে তার সম্যক জ্ঞান থাকে না। অদৃষ্ট জীবের কর্মজাত শক্তি এবং অচেতন। প্রকৃতিও অচেতন। কাজেই অদৃষ্ট নিজে বা প্রকৃতি অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। অচেতন অদৃষ্ট এবং প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন সচেতন, সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান পুরুষের প্রয়োজন এবং ঈশ্বর হলেই সেই পুরুষ। কাজেই ঈশ্বর আছেন।
উপসংহার : যোগশাস্ত্রকারেরা বলেন, ঈশ্বর-প্রণিধান (অর্থাৎ ঈশ্বরের ধ্যান) সমাধি তথা মুক্তিলাভের প্রকৃষ্ট উপায়। যে সাধক ঈশ্বরে কর্মফল সমর্পণ করে একাগ্রতা সহকারে সর্বক্ষণ ঈশ্বরের ধ্যান করেন ঈশ্বর দয়াপরবশ হয়ে তাঁর চিত্তের সমস্ত মনিলতা অপসারিত করেন এবং সমাধিলাভের পথে যে সমস্ত বাধাবিঘ্ন আছে তাদের দূর করেন। ফলে তাঁর যোগ সাধনায় সিদ্ধি লাভ ত্বরান্বিত হয়। তবে অযোগ্য ব্যক্তির উপর ঈশ্বরের দয়া বর্ষিত হয় না। তাই যম-নিয়মাদির অনুশীলনের দ্বারা ঈশ্বরের করুণালাভের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।