অথবা, যুবক বলতে তুমি কি বুঝ? তোমার মতে বাংলাদেশের যুবকদের চাহিদাসমূহ কি কি?
অথবা, যুবকের সংজ্ঞা দাও। যুবকদের চাহিদা কী কী বর্ণনা দাও।
অথবা, যুবক কাকে বলে? যুবকদের অন্তভূত চাহিদাসমূহ লিখ।
অথবা, যুবক ধারণাটি ব্যাখ্যা কর। তোমার মতে যুবকদের চাহিদা কী হতে পারে।
অথবা, যুবকদের চাহিদা উল্লেখ পূর্বক যুবক ধারণাটি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।। ভূমিকা : যুবক সম্প্রদায় হল একটি দেশ ও জাতির সকল শক্তি ও ক্ষমতার উৎস। একটি দেশের যুব সম্প্রদায় যতবেশি যোগ্য, দক্ষ ও শিক্ষিত ঐ দেশ ততবেশি উন্নত। যুবক বলতে একটা দেশের সম্ভাবনাময় ও উৎপাদনশীল জনগণকেই বুঝায়। বাংলাদেশে বর্তমানে সোয়া চার কোটি যুবক রয়েছে। যার অনুপাত ৩০.৩৬%। বিভিন্ন দেশে যুবকদের বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
যুবক : সাধারণ অর্থে যুবক বলতে একটি দেশের তরুণ সম্প্রদায়কে বুঝায়, যাদের মধ্যে গতি আছে, সাহস আছে, শক্তি আছে, উৎসাহ আছে, আছে পরিবর্তনের স্পৃহা এবং সেজন্য বাসনা ও প্রচেষ্টা।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : যুবকদের চাহিদা সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল :
আমিরুল ইসলাম (১৯৮৫) যুব জীবন নামক সাময়িকীতে তার ‘বর্তমান যুবসমাজ’ নামক প্রবন্ধে যুবকের সংজ্ঞায় বলেছেন, “সাহস যাদের অপরিসীম, মৃত্যুতে যাদের ভয় নেই, শক্তি যাদের অপরিসীম, দুর্দমনীয় যাদের গতি, বিপুল যাদের আশা, উৎসাহ যাদের অসীম, বিরাট যাদের উদারতা, অতুল যাদের সাধনা, অশান্ত যাদের মন, পরিবর্তন স্পৃহা যাদের অদম্য তারাই যুবক।”
মনোবিজ্ঞানী ড. সিগমা ও নূম্যান বলেছেন, “যুবকরা হচ্ছে এমন এক সম্প্রদায় যারা অভিন্ন ইতিহাসের কালপর্বে দাঁড়িয়ে সমান অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অংশিদারভিত্তিক আশা নিরাশায় সমৃদ্ধ।”
এলিড ফুয়েল বলেছেন, “তারাই যুবক যারা পূর্ণ বয়স্ক এবং মরপ্রশক্তির উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক। তারা সাধারণত মাঝারি বয়সের অধিকারী।”
আলোচ্য সংজ্ঞাগুলোতে সাংস্কৃতিক, মূল্যবোধ ও আচরণের ভিত্তিতে যুবকদের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও শারীরিক ভিত্তিতে (বয়স অনুযায়ী) যুবকদের সংজ্ঞায়িত করা হয়। যেমন—
বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান যুবনীতি অনুযায়ী যাদের বয়স ১৮-৩৫ বছরের মধ্যে তারাই যুবক।জাতিসংঘের মতে, ১৫-২৪ বছর বয়সীরাই হল যুবক। সুতরাং বলা যায়, যুবক হল তারাই যারা শারীরিক ও সাংস্কৃতিক উভয় মানদণ্ডের বৈশিষ্ট্য অর্জনে সক্ষম। এরা বয়সের দিক থেকেও যেমন নবীন তেমনি চিন্তাচেতনায়ও হবে নবীন ও সৃজনশীল।
যুবকদের চাহিদা : শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মত যুবসমাজেরও কিছু স্বতন্ত্র চাহিদা রয়েছে।এক্ষেত্রে বিভিন্ন মনীষীও তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে যুবকদের চাহিদাসমূহ তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
মনীষীদের মতামতের পাশাপাশি যুবসমাজের সর্বজনীন চাহিদাসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হল :
ডি. পল. চৌধুরী তার “A Hand Book of Social Welfare” গ্রন্থে যুবকদের নিম্নোক্ত চাহিদাসমূহের কথা বলেছেন :
১. দায়িত্ববান ও পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠার জন্য ব্যক্তিত্বের সঠিক বিকাশ।
২. বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আবেগীয় স্বাধীনতা।
৩. সমবয়সী বন্ধু ও বিপরীত লিঙ্গের সাথে সুষ্ঠু মেলামেশা ও পারিবারিক জীবনের জন্য প্রস্তুতি।
৪. অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য পেশা নির্ধারণ।
নুরুল ইসলাম ও ড. মুহম্মদ সাদেক তাঁদের “সমাজকল্যাণ নীতি ও কর্মসূচি” নামক বইতে যুবকদের ৭টি প্রধান চাহিদার কথা বলেছেন। যথা :
১. দৈহিক চাহিদা :
ক. শারীরিক বৃদ্ধি । খ. দৈহিক শক্তি। গ. স্বাস্থ্য সচেতনতা।
২. মানসিক চাহিদা :
ক. জীবনের সর্বক্ষেত্রে অধিক স্বাধীনতার স্বাদ। খ. বর্তমান অবস্থার উপর অসন্তুষ্টি। গ. সকল কাজে বেশি উৎসুক্য।
ঘ. খুব বেশি চঞ্চলতা। ঙ. খুব বেশি অস্থিরতা।
৩. সামাজিক চাহিদা :
ক. বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। খ. নতুন নতুন সমবয়সীদের সাথে মেলামেশা করা।গ. পরিচিত হওয়া। ঘ. দল গঠন করা।
ঙ. প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা। চ. নেতৃত্বদানের চেষ্টা করা।
৪. সাংস্কৃতিক চাহিদা :
ক. বিভিন্ন চিত্তবিনোদন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ এবং সৃষ্টিশীল কাজে সময় ব্যয় করা।
৫. বুদ্ধিভিত্তিক চাহিদা :
ক. অজানাকে জানার আগ্রহ। খ. ব্যক্তিগত ও গুটিকতক অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ নিয়ম প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা।
গ. পরিবর্তনশীল আগ্রহ।
৬. পেশাগত চাহিদা :
ক. ভবিষ্যৎ কর্মজীবন সম্পর্কে উদ্বেগ । খ. উচ্চাভিলাষী মনোভাব । গ. বাস্তবতা বহির্ভূত কাল্পনিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হওয়া।
৭. আদৰ্শগত চাহিদা :
ক. জীবনে আদর্শবাদী হওয়ার চেষ্টা করা। খ. নতুন আদর্শ ও চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হওয়া।
সার্বিকভাবে যুবকদের মধ্যে নিম্নলিখিত চাহিদাসমূহ পরিলক্ষিত হয় :
১. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : যুবকদের যদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করা না হয় তবে তারা বিভিন্ন অসংগতিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে। যুবকদের মধ্যে যদি এ দু’টি বিষয় না থাকে তবে তারা উন্নতি করতে পারবে না। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব তাদের পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এখানে তাদের Health education, family life education এর দরকার রয়েছে।
২. কর্মসংস্থানের সুযোগ : কথায় বলে কর্মহীন মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ থাকলেই হবে না।যুবকদের কর্মের সুযোগও থাকতে হবে। যাতে তারা কাজ করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পায়। কারণ কাজ না পেলে
সমাজে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।আর বেকারত্ব বিচ্যুত আচরণের জন্য দায়ী। সেজন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে যুবকদের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
৩. স্বাস্থ্য সুবিধা : স্বাস্থ্যহীন ব্যক্তিরা পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা। অন্যদের মত যুবকদেরও স্বাস্থ্য সুবিধা লাভের চাহিদা রয়েছে। যুব শক্তি জাতির চালিকাশক্তি। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য যুবকদের স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে এ দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থনীতিবিদ রায়হান শরীফ বলেছেন, “যে জাতি স্বাস্থ্য তথা সামাজিক খাতে যতবেশি বিনিয়োগ করে সে জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা সামাজিক উন্নয়ন তত ত্বরান্বিত হয়।”
৪. ফলপ্রসূ সমষ্টি উন্নয়ন তৎপরতার অংশগ্রহণ : কোন দেশের অনুন্নত এলাকায় মানুষকে সংগঠিত করে সরকার এবং তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় সমষ্টি উন্নয়নের প্রচেষ্টাই হল সমষ্টি উন্নয়ন। সমষ্টি উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুবকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। অর্থাৎ সমষ্টির জন্য নীতি নির্ধারণ, কর্মসূচি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যুবকদের অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
৫. ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সাথে সংগতি বিধান : সংগতি বিধান করে চলতে না পারলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের মনোসামাজিক সমস্যার জন্ম নেয়। তবে একথা সত্য যে প্রত্যেক সমাজের নৈতিকতা এক নয়। যুবকরা যে যে সমাজে বসবাস করবে তাদেরকে সে সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে সংগতি বিধান করে চলতে হবে। এ সংগতি বিধানে ব্যর্থ হওয়ার ফলে অনেক যুবকই নষ্ট হয়ে যায়, বিপথে গমন করে।
৬. জাতীয় ঐতিহ্য দিয়ে গর্ব করার সাহস : জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য একটি অধিকার। তারা নিজেদের অতীত সম্পর্কে জানবে এবং তা দিয়ে তারা গর্ববোধ করবে এমন মানসিকতা রাষ্ট্রের।প্রত্যেকটি নাগরিকের পোষণ করা উচিত। আমাদের যুবকদের এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদেরকে জাতীয় গৌরবের সাথে একাত্ম ঘোষণা করতে হবে। সেজন্য তাদের মধ্যে সাহসিকতার সঞ্চার ঘটাতে হবে।
৭. জাতীয় মর্যাদায় সন্তুষ্টি লাভ : যুবসমাজের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হল জাতীয় মর্যাদায় সন্তুষ্টি লাভ করা।তাদেরকে জাতীয় যে মর্যাদা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তাদেরকে এ নিয়ে হীনমন্যতায় কিংবা হতাশায় ভুগলে
চলবে না। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি থাকতে হবে। প্রত্যেক যুবককেই দেশের মর্যাদা রক্ষা ও বৃদ্ধির ব্যাপারে অনুভূতিশীল করে গড়ে তুলতে হবে।
৮. ব্যক্তিগত আবেগের সন্তুষ্টি লাভ: আবেগ হল ব্যক্তির মধ্যে এমন একটি আন্দোলিত অবস্থা যা তারা আচার আচরণ এবং অঙ্গভঙ্গি দ্বারা প্রকাশ পেতে পারে আবার নাও পেতে পারে। তবে ব্যক্তিজীবনে আবেগের বহিঃপ্রকাশ জরুরি।আবেগের পরিপূর্তি না হলে তা বিচ্যুত আচরণের রূপ নেয়। তাই যুবকদের ব্যক্তিগত আবেগ পূরণের সুযোগ দিতে হবে।তাদের গ্রহণযোগ্যতা দেখাতে হবে। এটা তাদের অন্যতম প্রধান চাহিদা।
৯. ব্যক্তিস্বাধীনতা : একজন ব্যক্তি হিসেবে তার চিন্তাচেতনা, আবেগ অনুভূতি, মতামত ইত্যাদি গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে যুবকরা কারও অযাচিত হস্তক্ষেপ কামনা করে না। অর্থাৎ যুবকদেরকে তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার কর্মনির্বাচন,
কর্মসম্পাদনের অধিকার দিতে হবে। তাদের উপরে জোর করে কোন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কিংবা সামাজিক মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, একটি সমাজ তথা রাষ্ট্রকে গতিশীল ও উৎপাদনমুখীকরণের জন্য যুবসমাজের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ চিন্তায়, কর্মে, সাধনায়, ত্যাগে সকল ক্ষেত্রেই যুবকদের অবদান অপরিসীম। সুতরাং যুবকরা যেহেতু সমাজ ও জাতির কল্যাণের জন্য নিজেদের নিয়োজিত করে তাই সমাজ তথা রাষ্ট্রের উচিত যুবকদের চাহিদাগুলোর দিকে বিশেষ নজর দেওয়া। কারণ যুবকদের চাহিদা পূরণ না হলে তারা সৃষ্টিশীল কাজের পরিবর্তে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হবে। তাই যুবকদেরকে ইতিবাচক কর্মে নিয়োজিত করার জন্য তাদের চাহিদাগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তবেই আসবে দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি ও উন্নতি।