যুক্তি সম্পর্কে জৈনদের অভিমত আলোচনা কর।

অথবা, অনুমান সম্পর্কে জৈনদের অভিমত আলোচনা কর।
অথবা, জৈনরা যুক্তি সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন? ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জৈনরা অনুমান সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
জৈন দর্শনের প্রচারক হলেন চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর। এ চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে সর্ব প্রথম তীর্থঙ্কর হলেন মহাবীর। তাই মহাবীরকেই জৈন দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলে ধারণা করা হয়। জৈনগণ নিরীশ্বরবাদী। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষ বা যুক্তির কোনটির সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। তারপরও জৈন দর্শনে যুক্তির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
যুক্তি সম্পর্কে জৈনদের অভিমত : জৈনদের মতে, কোন বস্তু সম্পর্কে কোন যুক্তি বা অবধারণ প্রকাশ করার সময় তাকে শর্তহীন না করে শম্ভুসহ করা উচিত। এ শর্ত হলো ‘স্যাৎ’। ‘স্যাৎ’ শব্দের অর্থ হলো ‘সম্ভবত’। প্রতিটি যুক্তি বা অবধারণ প্রকাশ করার সময় ‘স্যাৎ’ বিশেষণটি যোগ করে দেয়া উচিত। যেমন- ‘হস্তী কুলার মত’ এ কথা না বলে ‘সম্ভবত
হস্তী কুলার মত’ এ কথা বলা উচিত। জৈনদের মতে, প্রতিটি যুক্তির বা অবধারণে যদি ‘স্যাৎ’ শব্দটি থাকে তবে এটা স্পষ্ট বুঝায় যে, যুক্তিটি বা অবধারণটি আংশিক সত্য এবং আলোচ্যবস্তু সম্পর্কে বিকল্প অবধারণও সত্য হতে পারে। জৈনদের এ মতবাদের নামই স্যাদবাদ বা অবধারণ বা যুক্তি।
এ মতবাদ অনুসারে সসীম ও অপূর্ণ মানুষ কোন বস্তু সম্পর্কে যে যুক্তি বা অবধারণ রচনা করে সে যুক্তি বা অবধারণ বস্তুর কোন একটি দিক হতে সত্য। অর্থাৎ এর সত্যতা শর্তাধীন, কিন্তু সর্বদিক হতে সত্য নয়। অর্থাৎ এর সত্যতা নিঃশর্ত নয়। জৈনগণের মতে, একটি বস্তুর অসংখ্য গুণ আছে। একমাত্র সর্বজ্ঞ মানুষ তার ‘কেবল জ্ঞান দ্বারা বস্তুর অসংখ্য
গুণগুলোকে একসাথে জানতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ সসীম জীব বলে তাদের পক্ষে একসাথে সব গুণ জানা সম্ভব নয়। কোন বস্তুর অসংখ্য গুণের মধ্যে যে কোন একটি সম্পর্কে যে জ্ঞান তাকে জৈনরা ‘নয়’ বলেছেন। বস্তুর এ আংশিক জ্ঞানের মূলে যে যুক্তি বা অবধারণ তাকেও তারা ‘নয়’ বলেছেন।
জৈনগণ সাত প্রকার যুক্তির বা অবধারণের কথা বলেছেন। জৈনগণের ‘সপ্তভঙ্গী নয়’ এর উৎপত্তি হয় স্যাদবাদ হতে। এ সাত প্রকার ‘নয়’ এর প্রত্যেকটি যে আংশিক সত্য তা প্রমাণ করার জন্য জৈনগণ প্রত্যেকটি ‘নয়’ এর প্রারম্ভে স্যাৎ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। জৈনদের মতে, যে কোন উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাত রকম যুক্তি বা অবধারণ রয়েছে, যা নিম্নরূপ :
১. স্যাৎ অস্তি; ২. স্যাৎ নাস্তি; ৩. স্যাৎ অস্তি চ, নাস্তি চ; ৪. স্যাৎ অবক্তব্যম; ৫. স্যাৎ অস্তি চ অবক্তব্যম্ চ; ৬. স্যাৎ নাস্তি চ, অবক্তব্যম্ চ এবং ৭. স্যাৎ অস্তি চ, নাস্তি চ, অবক্তব্যম্ চ।
১. একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি অবগাহন করা যায়। যেমন- আম হলো উদ্দেশ্য। এর সাতটি অবধারণ রচনা করতে হবে। সদর্থক অবধারণে আমরা একটি গুণ স্বীকার করব। যেমন- মিষ্টতা, এর তর্ক বিজ্ঞানসম্মত বচন হবে ‘আম হয় মিষ্ট’। কিন্তু জৈনরা ‘আম হয় মিষ্ট’ না বলে ‘সম্ভবত আম হয় মিষ্ট’ (স্যাৎ অস্তি) বলবেন। অর্থাৎ কোন
বিশেষ দেশে, কোন বিশেষ কালে, কোন বিশেষ অবস্থায় আম মিষ্ট।
নঞর্থক অবধারণে মিষ্টতা গুণটি অস্বীকার করা হবে। অতএব, বচন হবে ‘আম নয় মিষ্ট’ কিন্তু জৈনরা ‘আম
মিষ্ট নয়’ না বলে ‘সম্ভবত আম নয় মিষ্ট’ (স্যাৎ নাস্তি) বলবেন।
কোন এক দেশে, কোন এক কালে, কোন এক অবস্থায় আম যদি মিষ্টি হয় এবং মিষ্টি না হয়, তাহলে জৈনরা
বলবেন, সম্ভবত আম মিষ্টি এবং মিষ্টি নয় (স্যাৎ অস্তি চ, নাস্তি চ)।
কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, সর্বদেশে, সর্বকালে এবং সর্বাবস্থায় আমের গুণ কি হবে? এর উত্তরে ‘এটা বলা যায়
না’ বলা হয়। কিন্তু চতুর্থ স্যাৎ মতে, জৈনরা বলেছেন, ‘সম্ভবত এটা অবক্তব্য’ (স্যাৎ অবক্তব্যম)।
প্রথম অবধারণের সাথে চতুর্থ অবধারণ যোগ করলে পঞ্চতম অবধারণ পাওয়া যায়। যেমন- কোন বিশ েষ
দেশে, কোন বিশেষ অবস্থায় আম হয় মিষ্টি এবং সবদেশে, সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় আম অবর্ণনীয়। এটাকে জৈনরা বলবেন, “সম্ভবত আম হয় মিষ্টি এবং অবক্তব্য” (স্যাৎ অস্তি চ, অবক্তব্যম চ)।
দ্বিতীয় অবধারণের সাথে চতুর্থটি যোগ করলে ষষ্ঠ অবধারণটি পাওয়া যায়। যেমন- কোন বিশেষ অবস্থায় আম মিষ্টি নয় এবং সর্বদেশে, সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় আম অবর্ণনীয়। এটাকে জৈনরা বলবেন, ‘সম্ভবত আম
নয় মিষ্টি এবং অবক্তব্য’ (স্যাৎ নাস্তি চ, অবক্তব্যম চ)।
তৃতীয় অবধারণের সাথে চতুর্থ অবধারণ সংযুক্ত করলে সপ্তম অবধারণটি পাওয়া যায়। অতএব, জৈনরা বলবেন, ‘সম্ভবত আম মিষ্টি এবং মিষ্টি নয় এবং অবক্তব্য’ (স্যাৎ অস্তি চ, নাস্তি চ, অবক্তব্যম্ চ)।
জৈনদের মতে, যে কোন উদ্দেশ্য সম্পর্কে ‘সাত রকমের অবধারণ ছাড়া আর বেশি কোন অবধারণ হতে পারে না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও বৌদ্ধ ও বৈদান্তিকগণ কঠোর ভাষায় জৈনদের যুক্তির সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, যুক্তি বা অবধারণ উম্মাদের প্রলাপমাত্র। কারণ এ যুক্তির সাহায্যে জৈনগণ বস্তুর সত্তা ও অসত্তা, একত্ব ও বহুত্ব, ভেদ ও অভেদ, সামান্য ও বিশেষ প্রভৃতি বিরুদ্ধ ধর্মের সমন্বয় করতে চেয়েছেন। এসব বিরোধী ধর্ম
আলোক ও অন্ধকারেরই মত একই অধিকরণে থাকতে পারে না। বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও জৈনদের যুক্তি বাস্তব ও
অলৌকিক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচায়ক।