অথবা , যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয়মুখি প্রবণতা উল্লেখ কর।
উত্তর: ভূমিকা : “Federation is a political contrivance intended to reconcile national unity with the maintenance of states rights.”
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন এবং উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যথা: এককেন্দ্রিক সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার। তবে এ দুটি সরকারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা অন্যতম। আর বিশ্বের সকল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একটি সাধারণ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়, তাহলো কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার অত্যধিক প্রসার ও বৃদ্ধি। আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে ।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক প্রবণতাসমূহ : আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বহুবিধ সাম্প্রতিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে এর কারণসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো :
১. যুদ্ধ ও যুদ্ধের ভীতি: দুদ্ধ এবং যুদ্ধের ভয়ভীতি হচ্ছে আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় প্রবণতার সর্বাপেক্ষা
প্রধান কারণ। যুদ্ধের ক্ষেত্রে সামরিক ক্ষেত্রে প্রস্তুতি কেন্দ্রীয়ভাবে হওয়া আবশ্যক। কেননা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশের সর্বশক্তি এবং সম্পদকে একত্রিত করে সেগুলোকে যুদ্ধকার্যে নিয়োজিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। আর এ কাজ করা আঞ্চলিক সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যুদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
২. অর্থনৈতিক মন্দা : বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ, মুদ্রাক্ষীতি ইত্যাদি কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দাভাব দেখা দেয় তা মোকাবিলার সামর্থ্য আঞ্চলিক সরকারের নেই বললেই চলে। অর্থনৈতিক মন্দা যে রাষ্ট্রীয় সমস্যার সৃষ্টি করে তার সমাধান করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক মন্দার সময় স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষনতা বৃদ্ধি পায়।
৩. যোগাযোগ ও শিল্পক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন : বর্তমান যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হওয়ায় কোন প্রদেশে কিছু সমস্যা দেখা দিলে কেন্দ্রীয় সরকার তৎক্ষণাৎ এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া যোগাযোগ ও শিল্পক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। ফলে সরকারের বেশিরভাগ কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Lipson বলেছেন, Virtually all the great driving force is modern society combine in a centralist direction.”
৪. আন্তর্জাতিক রাজনীতি : আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণেও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক বিশ্বের স্নায়ুযুদ্ধ, সামরিক শক্তি সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা, পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এলাকাভিত্তিক মতাদর্শগত প্রভাব বিস্তারের উদ্যোগ, পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার প্রতিযোগিতা প্রভৃতি বিষয়ও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।
৫. আঞ্চলিক সরকারগুলোর ব্যর্থতা: যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের কেন্দ্রীয় প্রবণতার আর একটি কারণ হলো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্যে আঞ্চলিক সরকার বাধা প্রদানে অসামর্থ্য। কোন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়ই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব প্রতিপত্তি আঞ্চলিক সরকার রোধ করেত পারে না। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তার উপর আঞ্চলিক সরকারকে নির্ভরশীল থাকতে হয়।
৬. প্রচারমাধ্যমগুলোর দ্রুত প্রসার লাভ : আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের যুগে প্রচারমাধ্যম জাতীয় ঐক্য ও সংহতির উপর গুরুত্বারোপ করে জনগণকে প্রভাবিত করে। ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে এটি কেন্দ্রীয়করণ করতে যথেষ্ট আগ্রহী হয়।
৭. অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা: একথা সত্য যে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা গৃহীত হওয়া উচিত। তাছাড়া জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নানাবিধ কার্যাবলি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দরকার। কেননা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যতীত জনগণের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার মান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে যদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণীত না হয় তাহলে সমগ্র দেশের সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে না।
৮. রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। এ প্রবণতাও কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিকে দিন দিন বৃদ্ধি করছে।
৯. সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক যুক্তি : ধনতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বলা যায় যে, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের ব্যাপক বিস্তৃতির জন্যই কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবার সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বলা যায় যে, পুঁজিপতিগণই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে নিজেদের একচেটিয়া ব্যবসায় বাণিজ্য ও
অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করে। ফলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়।
১০. বিচার বিভাগের ভূমিকা : সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচার বিভাগ কেন্দ্রীয় শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাছাড়া বিচারপতিদের সিদ্ধান্তও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করে। অনেক সময় বিচারপতিরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে পুরাতন সংবিধানের সামঞ্জস্য বিধান করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে রায় দেয়।
১১. দৃষ্টভঙ্গির পরিবর্তন : বর্তমান কালে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কারণেও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অধিবাসীদের মধ্যে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার পরিবর্তে জাতীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
১২. জাতীয় ঐকমত্য প্রশ্নে: অঙ্গরাজ্যগুলোতে অধিকাংশ সময়ই স্বল্পকলহ লেগে থাকে। অনেক সময় এ দ্বন্দ্বকলহ বিচ্ছিন্নতাবাদীতে পরিণত হতে পারে, যা রাষ্ট্রের ঐক্যের প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। তাই জাতীয় ঐক্য রক্ষার্থে জনগণ অধিকতর ক্ষমতা প্রদানে দ্বিমত পোষণ করে না।
১৩. জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব : আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কার্যাবলি বর্তমানে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব বহুমুখী কার্যাবলি সম্পাদনের ব্যাপারে আঞ্চলিক সরকারগুলোর আর্থিক সংগতি ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মোটেই উপযুক্ত নয়। তাই কেন্দ্রকেই আর্থিক এবং প্রশাসনিকভাবে সহায়তা করতে হয় এবং এর ফলে কেন্দ্রের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়।
১৪. সংবিধান সংশোধন : প্রতিটি দেশেই কমবেশি সংবিধান সংশোধিত হয়ে থাকে। আর সংবিধান সংশোধনকালে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এরূপ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে স্বীয় ক্ষতভাকে সুদৃঢ় করে তোলে।
উপসংহার : উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাম্প্রতিক প্রবণতা কেন্দ্রের
দিকে দিন দিন ধাবিত হচ্ছে এবং বর্তমানে বিশ্বের সকল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতেই এ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয়
সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা প্রতিহত করার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারগুলোর নেই। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে বর্তমানে এমন একটা নীতি গ্রহণ করা উচিত, যাতে কেন্দ্রের সাথে অঙ্গরাজ্যের বহু না বাধে এবং সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালিত হয়।