অথবা, মৌল মানবিক চাহিদা কি? শিল্পায়ন কিভাবে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে অবদান রাখে আলোচনা কর।
অথবা, মৌল মানবিক চাহিদা কাকে বলে? বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে শিল্পায়নের প্রভাব বর্ণনা কর।
অথবা, মৌল মানবিক চাহিদার সংজ্ঞা দাও।মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে শিল্পায়নের অবদানসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই জীবনধারণ, বংশবৃদ্ধি ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য মানুষের নানারকম জিনিসের প্রয়োজন হয়। এসব নানারকম জিনিসের মধ্যে যেসব জিনিস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেগুলোই মৌল মানবিক চাহিদা। অর্থাৎ যেসব চাহিদা পূরণ ছাড়া মানুষ সমাজে সভ্য মানুষ হিসেবে বসবাস করতে পারে না তাদের
সমষ্টিকে মৌল মানবিক চাহিদা বলে। শিল্পায়ন হল শিল্পের বিকাশ। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে শিল্পায়নের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। কারণ একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে শিল্পায়নের উপর।
মৌল মানবিক চাহিদা : মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য যেসব প্রয়োজন পূরণ করা অত্যাবশ্যক তাকে মৌল মানবিক চাহিদা বলে। এ চাহিদাগুলো এতটাই প্রয়োজনীয় যে, এগুলোর অভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না। যেমন- খাদ্যের অভাবে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : মৌল মানবিক চাহিদা সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হল :
অধ্যাপক ড. মোঃ নূরুল ইসলাম মৌল মানবিক চাহিদা সম্পর্কে বলেছেন, “Which needs are essential for human life are call Basic human need.” অর্থাৎ, মানুষের জন্য যেসব জিনিস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তাকে মৌল
মানবিক চাহিদা বলে।
ডেভিড জেরী ও জুলিয়া জেরী কলিঙ্গ সমাজবিজ্ঞান অভিধান সম্পাদনা করেন। উক্ত অভিধানে তাঁরা বলেছেন, “Basic human needs the conception that all human beings sure fundamental needs by virtue of their humanity. The fulfillment of these full participation in social life.” অর্থাৎ, মৌল মানবিক চাহিদা হল একটি ধারণা, যেখানে মানুষ সকল মানবিকতার কারণে মৌলিক চাহিদায় অংশগ্রহণ করে। সমাজজীবনে পূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়।
উপরের আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, মৌল মানবিক চাহিদা হল সেসব প্রয়োজনের সমষ্টি যা মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক। এগুলো পূরণ না হলে মানুষ বাঁচতে পারে না ও সামাজিকতা রক্ষা
করতে পারে না।
মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে শিল্পায়নের প্রভাব : একটি দেশ কতটা উন্নত তা নির্ভর করে ঐ দেশ শিল্পোন্নত কি না তার উপর। শিল্পে উন্নত হলে দেশও উন্নত হয়, দেশের অর্থনীতিও উন্নত হয়। ফলে জনগণের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে । আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে মৌল মানবিক চাহিদাও সঠিকভাবে পূরণ হয়। নিম্নে মৌল মানবিক চাহিদার উপর শিল্পায়নের প্রভাব আলোচনা করা হল :
১. খাদ্য চাহিদা পূরণ : শিল্পায়নের প্রভাব খাদ্য চাহিদার উপর পড়ে। কৃষিক্ষেত্রে যে কাঁচামাল উৎপাদিত হয় তা শিল্পে ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য উপযোগী করা হয়। তাই দেখা যায় ধান থেকে নানারকম খাদ্য উপযোগী জিনিস তৈরি হয় ।
এছাড়া আরও অনেক রকম খাবার আছে যা শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদিত হয়।
২. বস্ত্র চাহিদা পূরণ : বস্ত্র মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক প্রয়োজন। শিল্পের উন্নতি হলে তা মানুষের বস্ত্র চাহিদা পূরণে সহায়ক হয়। কারণ সবরকম কাপড় ও সুতা কলকারখানায় তৈরি হয়। তাই শিল্পায়ন বস্ত্র চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
৩. বাসস্থানের উপকরণ সরবরাহ : বাসস্থান মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক প্রয়োজন। আধুনিক যুগে মানুষ প্রকৃতিনির্ভর না হয়ে শিল্পসামগ্রী দিয়ে বাসস্থান তৈরি করে। যেমন- রড, সিমেন্ট, ইট, টিন ইত্যাদি। এসব গৃহনির্মাণ সামগ্রী শিল্পের মাধ্যমে পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, শিল্পায়ন গৃহনির্মাণ সামগ্রীর ব্যবস্থা করে থাকে।
৪. শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ : শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা। আধুনিক যুগে শিল্পের উপকরণ ছাড়া শিক্ষার কথা ভাবাই যায় না। শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ, কলম, বইপুস্তক শিল্পায়নের ফলেই আমরা পেয়ে থাকি।
তাই শিল্পায়ন শিক্ষাকে প্রসারিত করতে সহায়ক।
৫. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন : শিল্পায়নের ফলে কম সময়ে, কম শ্রম ব্যয়ে অনেক পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয়।ফলে এগুলোর দামও হয় কম। জনগণ সহজেই এসব সামগ্রী কিনতে পারে। ফলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
৬. ব্যাপক উৎপাদন : শিল্পায়নের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় যান্ত্রিক ব্যবহার শুরু হয়েছে। ফলে উৎপাদন বহুগুণে বেড়েছে। আগে কয়েকজন লোক যা একদিনে তৈরি করত এখন কারখানায় তা অতি অল্প সময়ে তৈরি হচ্ছে। ফলে বিশাল
জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ হচ্ছে সহজে।
৭. কর্মসংস্থান সৃষ্টি : শিল্পায়নের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ।উৎপাদন, উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ, বিপণন ইত্যাদি কাজে প্রচুর লোকের দরকার হচ্ছে।ফলে মানুষের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।
৮. স্বাস্থ্যের উন্নয়ন : স্বাস্থ্য মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা। বলা হয়, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শিল্পায়নের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নয়ন হচ্ছে। স্বাস্থ্য চাহিদার অন্যতম সামগ্রী ঔষধ শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়।এছাড়াও
চিকিৎসার অন্যান্য সরঞ্জামাদি শিল্পের মাধ্যমে আসে।
৯. জাতীয় আয় বৃদ্ধি : শিল্পোন্নয়ন মানুষের জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। শিল্পায়নের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী দেশের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত সামগ্রী বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। ফলে দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ও জাতীয় আয় বাড়ে। ফলে সহজেই মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ হয়।
১০. দারিদ্র্য বিমোচন : শিল্পায়ন দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করে থাকে। শিল্পায়নের ফলে বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।এতে মানুষের বেকারত্ব কমে ও আয় বৃদ্ধি পায়। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন হয়। দারিদ্র্য বিমোচন হলে মানুষের মৌল
মানবিক চাহিদা পূরণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
১১. যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : শিল্পায়নের ফলে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়। শিল্পের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী জনগণের কাছে পৌঁছানো ইত্যাদির জন্য যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়।যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়। অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হলে মৌল মানবিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হয়।
১২. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : শিল্পায়নের ফলে কোন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার হয়। কারণ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়। তাই প্রাকৃতিক সম্পদ; যেমন— গ্যাস, কয়লা, তেল ইত্যাদির সুষ্ঠু ব্যবহার হলে তা জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনে। এর সুফল হিসেবে জনগণ মৌল মানবিক চাহিদা সহজেই পূরণ করতে সক্ষম হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার একমাত্র মাধ্যম।হল শিল্পায়ন। কেননা বর্তমান বিশ্বে বাজার দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। তাই আধুনিক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে শিল্পায়ন আবশ্যক।শিল্পায়ন হলে জনগণের আয় বাড়বে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, দরিদ্রতা কমবে। মৌল মানবিক চাহিদাগুলো খুব সহজে পূরণ হবে।