অথবা, মৌল মানবিক চাহিদা কি? বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদার উপর পরিবার ব্যবস্থার প্রভাব আলোচনা কর।
অথবা, মৌল মানবিক চাহিদা কাকে বলে? তোমার মতে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত।
অথবা, মৌল মানবিক চাহিদার সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে অবদানসমূহ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ জন্মগ্রহণ করে, বড় হয়, বংশবৃদ্ধি করে।অর্থাৎ জন্মের পর হতে মানুষ ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে তার জীবন শেষ করে। আর যে কোন প্রাণীকেই জীবনধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। অন্যদিকে মানুষ সামাজিক জীব। সুতরাং মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য তাকে নানারকম চাহিদা পূরণ করতে হয়। এসকল চাহিদা পূরণ ছাড়া মানুষ সমাজে বাস করতে পারে না।মানুষের অত্যাবশ্যকীয় এ সকল চাহিদাসমূহকেই মৌল মানবিক চাহিদা বলে। মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে পরিবার ব্যবস্থা অন্যতম।
মৌল মানবিক চাহিদা : মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য যেসব প্রয়োজন পূরণ করা অত্যাবশ্যক তাকে মৌল মানবিক চাহিদা বলে। এ চাহিদাগুলো এতটাই প্রয়োজনীয় যে, এগুলোর অভাবে মানুষ বাঁচতে পারে না। যেমন- খাদ্যের অভাবে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : মৌল মানবিক চাহিদা সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করা হল :
অধ্যাপক ড. মোঃ নূরুল ইসলাম মৌল মানবিক চাহিদা সম্পর্কে বলেছেন, “Which needs are essential for human life are call Basic human need.” অর্থাৎ, মানুষের জন্য যেসব জিনিস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তাকে মৌল
মানবিক চাহিদা বলে।
ডেভিড জেরী ও জুলিয়া জেরী কলিঙ্গ সমাজবিজ্ঞান অভিধান সম্পাদনা করেন। উক্ত অভিধানে তাঁরা বলেছেন, “Basic human needs the conception that all human beings sure fundamental needs by virtue of their humanity. The fulfillment of these full participation in social life.” অর্থাৎ, মৌল মানবিক চাহিদা হল একটি ধারণা, যেখানে মানুষ সকল মানবিকতার কারণে মৌলিক চাহিদায় অংশগ্রহণ করে। সমাজজীবনে পূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়।
উপরের আলোচনা থেকে একথা বলা যায় যে, মৌল মানবিক চাহিদা হল সেসব প্রয়োজনের সমষ্টি যা মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক। এগুলো পূরণ না হলে মানুষ বাঁচতে পারে না ও সামাজিকতা রক্ষা
করতে পারে না।
মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবার ব্যবস্থার ভূমিকা : বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। এদেশে বেকারত্ব ও নির্ভরশীলতার হার অনেক বেশি। ফলে বাংলাদেশের পরিবার ব্যবস্থা লক্ষ্য করলে দেখা যায় এদেশে যৌথ পরিবার বেশি। কারণ নির্ভরশীলদের ভরণপোষণ পরিবারই করে থাকে। নিম্নে বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবার ব্যবস্থার ভূমিকা আলোচনা করা হল :
১. মৌলিক প্রতিষ্ঠান : পরিবার হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে পুরাতন ও আদি মৌলিক প্রতিষ্ঠান। মানুষ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, পরিবারে বড় হয়, পরিবারেই মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের সকল কর্মকাণ্ড পরিবারের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। ফলে মানুষের চাহিদাসমূহও পরিবারের মাধ্যমেই পূরণ হয়।
২. সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করে পরিবার : মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। তখন পরিবার তার সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করে। তাছাড়া অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় পরিবারের কোন সদস্য বিপদে পড়লে তার যাবতীয় নিরাপত্তা বিধান করে পরিবার। এছাড়া পরিবার ব্যক্তির সব ধরনের চাহিদা পূরণ করে থাকে।
৩. পরিবারের ধরন : মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ পরিবারের ধরনের উপর নির্ভর করে। যদি যৌথ পরিবার হয় তবে নির্ভরশীলদের সব চাহিদা পরিবার পূরণ করে থাকে। অন্যদিকে, একক পরিবার হলে তা সম্ভব হয় না। আমাদের দেশে
যৌথ পরিবার বেশি দেখা যায়। তাই পরিবারের সব সদস্যদের চাহিদা যৌথ পরিবার পূরণ করে থাকে।
৪. পারিবারিক সচ্ছলতা : মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবার সহায়তা করে। তবে যদি পরিবার সচ্ছল হয় তাহলে সব সদস্যের চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হয়। অন্যদিকে, পরিবার যদি সচ্ছল না হয় তাহলে সব সদস্যের চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হয় না। তাই পারিবারিক সচ্ছলতার উপরও মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ নির্ভর করে।বাংলাদেশে অধিকাংশ পরিবার সচ্ছল নয় বলে মৌল মানবিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না।
৫. নির্ভরশীলদের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে : বাংলাদেশে বেকারত্ব ও নির্ভরশীল নসংখ্যা বেশি। এছাড়াও এদেশে পঙ্গু, এতিম, বিধবা, বৃদ্ধ ইত্যাদির জন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই। এসব লোকও পরিবারের উপর নির্ভরশীল।পরিবার তাদের সব ধরনের চাহিদা পূরণ করে থাকে। তাই এসব নির্ভরশীল লোকদের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৬. শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি : বাংলাদেশে সাধারণত যৌথ পরিবার বেশি। তাই যৌথ পরিবারের প্রধান হন বয়স্ক ব্যক্তি।তাঁর কথা পরিবারের সবাই মেনে চলে। অন্যদিকে, ছোট শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ পরিবারের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
৭. একক পরিবার : বর্তমানে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গঠনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাধারণত স্বামী-স্ত্রী মিলে একক পরিবার গঠিত হয়। একক পরিবারে নির্ভরশীল ব্যক্তি থাকে না বলে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ সহজতর হয়।
৮. পারিবারিক সম্পদ বৃদ্ধি : বাংলাদেশে পরিবার ব্যবস্থায় দেখা যায় পরিবার প্রধানরাই ভূমিকা পালন করে থাকে।তবে পরিবারের সব সদস্যই পারিবারিক সম্পদ বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট থাকে । লক্ষ্য একটাই পারিবারিক সম্পদ বৃদ্ধি হলে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ সহজ হবে।
৯. রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা : বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। নানারকম সামাজিক সমস্যার কারণে রাষ্ট্র সব নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। কিন্তু পরিবার যে কোন উপায়েই হোক তার সদস্যদের সব ধরনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করছে। এক অর্থে পরিবার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে।
১০. সম্পদের ব্যবহার : বাংলাদেশের পরিবারগুলো তাদের আয় বৃদ্ধির জন্য পারিবারিক সম্পদের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করে। কারণ পারিবারিক সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ উপার্জিত হয়। আর আয় বাড়লে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ হয় সহজেই। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় সম্পদও বৃদ্ধি পায়।
১১. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি : বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। তাই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উপর আমাদের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ নির্ভর করে। আমাদের দেশে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা বেশি লক্ষ্য করা যায়।পরিবারের সব সদস্যই কৃষি কাজে সহায়তা করে থাকে। ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ে। এর ফলে মৌল মানবিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। নানা সমস্যার কারণে।রাষ্ট্রীয়ভাবে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তবে পরিবার তার প্রতিটি সদস্যের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সবরকম সহযোগিতা করে আসছে সুদূর প্রাচীনকাল থেকে। তাই বাংলাদেশে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।