অথবা, মৌলিক মানবিক প্রয়োজন কাকে বলে? বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক
প্রয়োজনগুলো কি কি আলোচনা কর।
অথবা, মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলো কী কী বর্ণনা কর।
অথবা, মৌলিক মানবিক প্রয়োজন প্রত্যয়টি ব্যাখ্যা কর? বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলো কী হতে পারে বলে মনে কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের জীবনধারণের জন্য অনেক জিনিসের প্রয়োজন হয়। এসবের মধ্যে আবার এমনকিছু প্রয়োজন আছে, যা মানুষের জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ এসব প্রয়োজনসমূহ পূরণ না হলে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বাস করতে পারে না। এ ধরনের প্রয়োজনসমূহকেই মৌলিক প্রয়োজন বলা হয়। বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় পাঁচটি বিষয় রয়েছে, যেগুলোকে বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন বলা হয়। তবে এসব মৌলিক প্রয়োজনগুলো বাংলাদেশে সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না।
মৌলিক মানবিক প্রয়োজন : মৌলিক মানবিক প্রয়োজন বলতে এমন কিছু বিষয়কে বুঝায় যা মানুষের জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। প্রয়োজনসমূহ ছাড়া মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বাস করতে পারে না।কারণ জীবনধারণের জন্য খাদ্য প্রয়োজন, সভ্য সমাজে বস্ত্র ছাড়া চলা যায় না, বাসস্থান ছাড়া মানুষ থাকবে কোথায়?আবার চিকিৎসার অভাবে মানুষ মারা যেতে পারে। এভাবে দেখা যায়, কোনটি ছাড়াই মানুষ চলতে পারে না। সুতরাং মানুষের জীবনের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় এমনকিছু বিষয়, যার কোন বিকল্প নেই, তাকেই মৌলিক মানবিক প্রয়োজন বা চাহিদা বলা হয়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন মনীষী বিভিন্নভাবে মৌলিক মানবিক প্রয়োজন সম্পর্কে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকজনের সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হল :
মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলো প্রায় সবদেশেই একরকম। সমাজবিজ্ঞানী Towle তাঁর ‘Common Human Needs’ গ্রন্থে মৌল মানবিক প্রয়োজন হিসেবে ছয়টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন । যথা :
১. খাদ্য (Food), ২. বস্ত্ৰ (Cloth),
৩. আশ্রয় (Shelter), ৩. শিক্ষা (Education),
৫. স্বাস্থ্য (Health) এবং ৬. চিত্তবিনোদন (Recreation)।
এছাড়াও কিছু কিছু গৌণ চাহিদা রয়েছে। যেমন- ধর্ম, স্বাধীনতা, যৌন চাহিদা, স্নেহ ও ভালোবাসা ইত্যাদি। মানুষ জীবনধারণের জন্য এগুলো পূরণ করে থাকে। তবে প্রকৃতিগতভাবে মৌলিক প্রয়োজনকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় । যথা ঃ
১. জৈবিক চাহিদা (Biological needs) এবং
২. মানবীয়/মানবিক চাহিদা (Human needs)।
মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের বৈশিষ্ট্য : মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. মানুষের বেঁচে থাকা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মৌলিক মানবিক চাহিদার বিকল্প নেই। মানুষ যে কোন উপায়ে এটা পূরণ করে থাকে।
২. মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলো একে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অর্থাৎ একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করা যায় না।
৩. পৃথিবীর সব দেশে, সব জায়গায় মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলো প্রায় এক ও অভিন্ন৷
৪. মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলো সব দেশে এক হলেও সব দেশে সমভাবে এটি পূরণ হয় না। কারণ কোন দেশ ধনী ও গরিব তার উপর মৌলিক চাহিদা পূরণ নির্ভর করে থাকে।
৫. মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলো সহজাত ইত্যাদি।
বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক প্রয়োজন : মানুষের জীবনধারণের জন্য যা একান্ত প্রয়োজন, যে প্রয়োজন পূরণ না হলে মানুষ, মানুষ হিসেবে বাঁচতে পারে না তাকে মৌলিক মানবিক প্রয়োজন বলে। মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলো সর্বজনীন। নিম্নে বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক প্রয়োজনগুলোর বর্ণনা করা হল :
১. খাদ্য : খাদ্য সব দেশের মানুষের জন্যই প্রধানত মৌলিক মানবিক প্রয়োজন। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়।অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষেরও প্রথম মৌল মানবিক প্রয়োজন হল খাদ্য। মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান হল খাদ্য।
সুতরাং ক্ষুধা নিবারণ ও বেঁচে থাকার জন্য আমরা যা খাই তাই খাদ্য। খাদ্য মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করে। শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও শক্তির যোগান দেয়। খাদ্য মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি সাধন করে থাকে। সুতরাং মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ও প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য খাদ্য আবশ্যক। খাদ্য প্রধানত ছয় প্রকার। যথা : আমিষ, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি। খাদ্য মোটামুটি তিন ধরনের কাজ করে থাকে। যথা :
ক. শরীরের বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করে,
খ. রোগ প্রতিরোধ করে এবং
গ. শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি দেয়।
২. বজ্র : মানুষের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় চাহিদা হল বস্ত্র। কারণ ছাড়া মানুষ সভ্য সমাজে চলতে পারে না। সেজন্য বস্ত্র হল মানুষের মৌল মানবিক প্রয়োজন। বস্ত্র শুধু সামাজিকতা রক্ষা করে তাই নয়। এটা রোদ, বৃষ্টি, শীত ও গ্রীষ্ম হতে মানুষকে রক্ষা করে। বস্ত্র মানুষের লজ্জা নিবারণ করে। এছাড়াও ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বিকাশ, রুচি ও সৌন্দর্যের জন্যও বস্ত্র অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আধুনিক যুগে বস্ত্র মানুষের মান সম্মানের পরিচায়ক।
৩. বাসস্থান : বাসস্থান মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা। কারণ বাসস্থান ছাড়া মানুষ চলতে পারে না।মানুষের যদি স্থায়ী ঠিকানা না থাকে, সারাদিন পরিশ্রম করে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে বিশ্রাম না নিতে পারে তাহলে মানুষের সুখশান্তি থাকে না। এছাড়া বাসস্থান মানুষকে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, শীত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে রক্ষা করে।বাসস্থান মানুষকে বন্য জীবজন্তুর আক্রমণ হতেও রক্ষা করে। তাই একটি সুন্দর বাসস্থান মানুষকে নিরাপত্তা দেয়। ফলে সে আরাম করে ঘুমাতে পারে। স্থায়ী বাসস্থান মানুষকে উন্নতি করতে সাহায্য করে। বর্তমানে সুন্দর বাসস্থান আভিজাত্যের প্রতীক।
৪. শিক্ষা : শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌল মানবিক চাহিদা। কারণ শিক্ষা ছাড়া মানুষ উন্নতি করতে পারে না এবং সভ্যতারও বিকাশ হয় না।আজকের এ সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে মূল অবদান রেখেছে শিক্ষা। শিক্ষা যেমন কোন মানুষকে মহৎ করে, তেমনি শিক্ষা উন্নয়নে সহায়তা করে। তাই দেখা যায়, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। তাই শিক্ষাও মানুষের মৌল মানবিক চাহিদার মধ্যে পড়ে।
৫. স্বাস্থ্য : স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। কারণ টাকা পয়সা, বাসস্থান, পোশাক-আশাক থাকলেই মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে না। সে সাথে মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক থাকতে হয়। কারণ একজন অসুস্থ ব্যক্তির অগাধ সম্পত্তি থাকলেও সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার কাছে কোনকিছুই ভালো লাগবে না। তাই স্বাস্থ্যকে মৌল মানবিক চাহিদা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।তাছাড়া স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিই জাতির সম্পদ। সে যেমন নিজের উন্নতি করতে পারে, তেমনি রাষ্ট্রেরও উন্নতি করে থাকে। স্বাস্থ্য বলতে দৈহিক ও মানসিক সুস্থতাকে বুঝায়।
৬. চিত্তবিনোদন : চিত্তবিনোদন সর্বশেষ মৌল মানবিক প্রয়োজন। কারণ অন্যান্য মৌল মানবিক প্রয়োজনের পাশাপাশি চিত্তবিনোদনেরও প্রয়োজন রয়েছে। এটা মানুষের মনের খোরাক। কারণ মানুষ কাজ করতে করতে একঘেয়ে হয়ে যায়। তার এ একঘেয়েমি দূর করার জন্য চিত্তবিনোদনের দরকার।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, মানুষের জীবনধারণ ও সামাজিকতা রক্ষার জন্য যা একান্ত প্রয়োজন অর্থাৎ, যা না হলে মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বাস করতে পারে না তাকে মৌলিক মানবিক প্রয়োজন বা চাহিদা বলে। মৌলিক মানবিক প্রয়োজন বিশ্বের সব দেশেই একই রকম।তাই বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়।বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারণের জন্য এসব প্রয়োজনসমূহের বিকল্প নেই।