ভূমিকা: ইসলামি সমাজে ইসলামি দর্শন প্রবর্তন করা ও সেই অনুযায়ী জীবন যাপন করার নামই হল ইসলামি দর্শন। ইসলামি দর্শন একটি জেনেরিক শব্দ যাকে বিভিন্ন উপায়ে সংজ্ঞায়িত এবং ব্যবহার করা যায়। বিস্তৃত অর্থে এটি ইসলামের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি যা ইসলামিক গ্রন্থে থেকে উদ্ভূত হয়েছে যা মূলত মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য এবং সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছা সম্পর্কে আলোকপাত করে। অন্য অর্থে এটি ইসলামি সাম্রাজ্যের অধীনে বা আরব-ইসলামি সংস্কৃতি এবং ইসলামি সভ্যতার ছায়াগ্রন্থের মধ্যে যেসব চিন্তাধারা বিকশিত হয়েছে এমন কোনও স্কুলকে বোঝায়। সংকীর্ণ অর্থে এটি ফালসাফার একটি অনুবাদ, অর্থ এই বিশেষ স্কুলগুলির মতামত যে অধিকাংশ নিওপ্লাটোনিজম ও এরিস্টটলীয়লিজমের মত গ্রিক দর্শনের পদ্ধতির প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। এটি ধর্মীয় বিষয় এবং মুসলমানদের দ্বারা উৎপাদিত কোন বিষয়ের সাথে জড়িত সম্পর্ক নয়। আর ইসলামের মধ্যে চিন্তার সমস্ত স্কুল দার্শনিক তদন্তের ব্যবহার বা বৈধতা স্বীকার করে না। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে মানুষের সীমিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কখনওই, সত্য ও সঠিক পথ অর্জনে সহায়তা করতে পারেনা। এটিও লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে, যখন “যুক্তি” (‘একিওএল’) কখনও কখনও ইসলামি আইনের উৎস হিসাবে স্বীকৃত হয়, তবে তার মধ্যে কখনও কখনও দর্শনের “যুক্তি” থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ থাকতে পারে। ইসলামি দর্শনের ইতিহাসগ্রাফী বিতর্ক দ্বারা চিহ্নিত বিষয়টি হল কিভাবে বিষয়টিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইবনে সিনা (আভিসিনা) এবং পশ্চিমা চিন্তাবিদ ইবনে রুশদের মত হল ইসলামিক দর্শন কীভাবে পড়তে হবে অথবা কীভাবে একে ব্যাখ্যা করা উচিত । লিও স্ট্রসের মতে ইসলামি দার্শনিকরা ধর্মীয় আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাদের প্রকৃত অর্থ গোপন করেছিলেন, কিন্তু ওলভার লিমানের মত পণ্ডিত তাতে মতানৈক্য প্রদর্শন করেছেন। নাম হিসাবে ইসলামি দর্শন বলতে ইসলামিক পদ্ধতিতে দার্শনিক কার্যকলাপকে বোঝায়। শাস্ত্রীয় বা প্রথমার্ধের ইসলামি দর্শনের মূল উৎস হল ইসলাম ধর্ম নিজেই (বিশেষ করে ধারণাগুলি কুরআন থেকে উদ্ভূত এবং ব্যাখ্যা করা হয়েছে) এবং গ্রিক দর্শন যা পূর্বের মুসলমানদের বিজয় লাভের ফলে পূর্ব ভারতীয়-ইসলামি দর্শন এবং ফার্সি দর্শনের সাথে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছে। দার্শনিক বিতর্কগুলির বেশিরভাগই ধর্ম এবং যুক্তিগুলির সমন্বয় সাধনের কেন্দ্রবিন্দু যা পরে গ্রিক দর্শনের দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল।
মুসলিম দর্শন: মুসলিম দর্শন হলো পরম সত্তা বা আল্লাহ , জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মুসলিম চিন্তাবিদদের চিন্তাধারার দর্পণ। দর্শনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেক দেশে, প্রত্যেক যুগে , প্রত্যেক জাতির একটা নিজস্ব দর্শন, নীতিবোধ তথা মূল্যবোধ সংক্রান্ত কতগুলো মৌলিক চিন্তাধারা থাকে।
ইসলামি দর্শন (ইংরেজি: Islamic philosophy, আরবি: فلسفة إسلامية ) অথবা আরবি দর্শন হল জীবন বিশ্বজগৎ নৈতিকতা সমাজ এবং মুসলিম বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত আরও অনেক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত সমস্যার উপরে নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা, অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা। ইসলামি দর্শন মূলত দুই ভাগে বিভক্তঃ কালাম ও ফালসাফা। ফালসাফা গ্রিক শব্দ, এটি গ্রিক দর্শন থেকে উৎসরিত। অপরদিকে কালাম অর্থ কথা বা বক্তব্য, এটি যুক্তিতর্ককে দর্শনে ব্যবহার করে। ইসলামি দার্শনিকদের মধ্যে সকলেই মুসলিম নন। ইয়াহিয়া ইবন আদির মত খ্রিষ্টান ও মাইমোনিডিস এর মত ইহুদীরাও ইসলামি দর্শন ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং ইবনে আল-রাওয়ান্দি ও মুহাম্মাদ ইবন জাকারিয়া আল-রাযীর মত অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ ইসলামকে আক্রমণ করার জন্য দর্শনশাস্ত্রকে ব্যবহার করেছিলেন। ৮ম শতাব্দীতে বাগদাদে সর্বপ্রথম স্বাধীনভাবে দার্শনিক অনুসন্ধান হিসেবে প্রাচীন ইসলামি দর্শনের উদ্ভব ঘটে। ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দী হল প্রাথমিক ইসলামি দর্শনের ব্যাপ্তিকাল, এ সময়কালকে ইসলামি স্বর্ণযুগ বলা হয়। দার্শনিক আল-কিন্দি এর সূচনা করেন এবং ইবনে রুশদের হাতে এই প্রাথমিক সময়কালটির সমাপ্তি ঘটে। ইসলামি দর্শন বলতে সাধারণত ইসলামি সমাজে সৃষ্ট দার্শনিক ভাবধারাকে বোঝানো হয়। এটির সাথে ধর্মীয় কোন বিষয়াবলীর সম্পৃক্ততা নেই, এমনকি একচেটিয়াভাবে মুসলমানদের কর্তৃক তৈরীকৃত বিষয়াবলীসমূহ।
দর্শনের সংজ্ঞা: দর্শনের সংজ্ঞা দেয়া কঠিন ব্যাপার। কেননা দর্শনের সংজ্ঞার ক্ষেত্রে অসংখ্য মতামত রয়েছে,ফলে অভিন্ন সংজ্ঞা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে ‘দর্শন’ শব্দটি মুসলিম সমাজে সাধারণত দু’ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে :
ক. প্রসিদ্ধ অর্থে
খ. অপ্রসিদ্ধ অর্থে
এ পর্যায়ে দর্শনের সংজ্ঞা দেয়া আমাদের জন্য সহজ হবে। প্রসিদ্ধ অর্থে দর্শনের বিশেষ কোন সংজ্ঞা নেই। কেননা সকল প্রকারের বুৎপত্তিগত জ্ঞানের সমষ্টিকেই দর্শন বলা হয়। এ ক্ষেত্রে সকল প্রকার যুক্তিভিত্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানই দর্শনের আওতাভুক্ত বিষয়। আর অপ্রসিদ্ধ অর্থে দর্শনের সংজ্ঞা হলো : যে শাস্ত্র অস্তিত্বের অস্তিত্বগত অবস্থা নিয়ে (এ দৃষ্টিতে যে,সে অস্তিত্ববান) আলোচনা করে তাকেই দর্শন বলা হয়। দর্শনশাস্ত্র যথাক্রমে তাত্ত্বিক (সূত্রগত) দর্শন ও ব্যবহারিক দর্শন-এ দু’ভাগে বিভক্ত।
তাত্ত্বিক দর্শন (حکمة نظری)
যে সকল বিষয়ের পরিচয় লাভ করা সম্ভব বা যে সকল বিষয়ের পরিচয় লাভ করা উচিত এরূপ সকল প্রকারের তাত্ত্বিক ও চিন্তামূলক জ্ঞান হলো তাত্ত্বিক দর্শনের আলোচ্য বিষয়। আর এ পরিচিতি বা জ্ঞানের বিষয়বস্তু হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাস্তবতা। তাত্ত্বিক দর্শনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। তবে এ বাস্তবতার আর দু’টি দিক রয়েছে;একটি হলো বিশ্বজগতের বস্তুগত বাস্তবতা,আর তা হলো প্রকৃতি,আরেকটি হলো অবস্তুগত বাস্তবতা।
ক. প্রকৃতি :
প্রকৃতি দর্শনে বস্তগত (পদার্থ) বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাস্তবতাসমূহের মূল্যগত মানের আলোকে বস্তুজগতের মূল্য সর্বনিম্নে। কেননা সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বগত পরম্পরায় বস্তুর অবস্থান সর্বনিম্নে,এজন্য প্রাকৃতিক দর্শনকে বলা হয় নিম্ন পর্যায়ের দর্শন।
খ. গণিত :
তাত্ত্বিক দর্শনের আরো একটি অংশ হলো গণিত। গণিতের আলোচ্য বিষয় হলো হিসাব,জ্যামিতি ইত্যাদি। আর গণিতের মূল বিষয়বস্তু হলো রেখা,তল,পরিমাণ ও সংখ্যা। অন্যদিকে গাণিতিক বিষয়বস্তুসমূহের গণিত হিসাবে বস্তুগত কোন রূপ না থাকায় এবং গণিত সম্পূর্ণ অবস্তুগত অস্তিত্ব না হওয়ায়,বাস্তবতাসমূহের মূল্যগত মানের ক্ষেত্রে গাণিতিক জগত বা গণিতের মূল্য বস্তুগত নিম্নমানের ঊর্ধ্বে এবং ইলাহিয়াতের (স্রষ্টাতত্ত্ব ও অধিবিদ্যার) নিচে অবস্থান করছে।
গ. স্রষ্টাতত্ত্ব (الهیات) :
তাত্ত্বিক দর্শনের আরো একটি অংশ হলো ইলাহিয়াত (স্রষ্টাতত্ত্ব) যা সার্বিক অস্তিত্বের বিধিবিধান সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে। অর্থাৎ স্রষ্টাতত্ত্বে অস্তিত্বের সার্বিক অস্তিত্বগত অবস্থা আলোচিত হয়ে থাকে। এই অস্তিত্বসমূহের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্বও একটি বিষয়। বরং প্রকৃত অর্থে সমস্ত অস্তিত্ব স্রষ্টার অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল। আর এজন্যই তাত্ত্বিক দর্শনের অস্তিত্ব সংক্রান্ত অংশটিকে বলা হয়ে থাকে স্রষ্টাতত্ত্ব। স্রষ্টাতত্ত্বকে আবার দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে :
১. সাধারণ স্রষ্টাতত্ত্ব
২. বিশেষ স্রষ্টাতত্ব
অন্যদিকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাস্তবতাসমূহের মূল্যগত অবস্থানের ক্ষেত্রে স্রষ্টাতত্ত্বের অস্তিত্বগত আলোচনার মান সবকিছুর ওপরে। তাই স্রষ্টাতত্ত্বকে বলা হয় সর্বোচ্চ দর্শন। শুধু তা-ই নয় বরং সকল বাস্তবতার অস্তিত্বগত ভিত্তি হলো স্রষ্টাতত্ত্ব,এজন্য স্রষ্টাতত্ত্বের মূল্য সবার শীর্ষে।
ব্যবহারিক দর্শন (حکمة عملی)
ব্যবহারিক দর্শনে ‘কোন বিষয়ের পরিচিতি লাভ করা উচিত’ তা আলোচ্য বিষয় নয়,বরং এ অধ্যায়ে আলোচ্য বিষয় হলো ‘কি করা উচিত’,আর ‘কি করা উচিত নয়’। ব্যবহারিক দর্শনকেও তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কেননা ব্যবহারিক কার্যক্রম কখনো কখনো ব্যক্তি জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট,আবার কখনো সামষ্টিক জীবনের সাথে,আবার কখনো রাষ্ট্রীয় জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মানুষের ব্যক্তিগত,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে তার কর্মক্ষেত্রের ওপর ভিত্তি করে ব্যবহারিক দর্শনকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে :
ক. নীতিশাস্ত্র : প্রত্যেক মানুষ ব্যক্তিজীবনে কিভাবে গড়ে উঠবে সে বিষয় নিয়ে নীতিশাস্ত্র আলোচনা করে থাকে। অর্থাৎ ব্যক্তিজীবনে কি কি বৈশিষ্ট্য তার জন্য উত্তম বা লাভ করা উচিত এবং কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্য থেকে সে নিজকে দূরে রাখলে সৌভাগ্যবান হবে এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নীতি দর্শন বিস্তারিত আলোচনা করে থাকে।
খ. পবিবার পরিচালনা সংক্রান্ত বিদ্যা :
পরিবার হলো সামাজিক জীবনের একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কি ধরনের নীতি বা পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত তা-ই পরিবার দর্শনে আলোচিত হয়ে থাকে।
গ. রাষ্ট্রবিজ্ঞান :
এখানে দ্বিপাক্ষিক দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে,একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ নিয়ে আলোচনা করা হয়। অর্থাৎ সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে রাষ্ট্রপ্রধানদের কি করা উচিত বা কোন্ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। আর অপরদিকে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে জনগণের দায়িত্ব কি? আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নে জনগণের ভূমিকা কি?
সংক্ষেপে তাত্ত্বিক দর্শন তিনভাগে বিভক্ত। যথাক্রমে :
ক. স্রষ্টাতত্ত্ব (সর্বোচ্চ পর্যায়ের দর্শন)
খ. গণিত (মধ্যম পর্যায়ের দর্শন)
গ. প্রকৃতি বিজ্ঞান (নিম্ন পর্যায়ের দর্শন)
আর ব্যবহারিক দর্শনকেও তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাক্রমে :
ক. নীতিশাস্ত্র।
খ. রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
গ. পরিবার পরিচালনা সংক্রান্ত বিজ্ঞান।
তাত্ত্বিক দর্শনে স্রষ্টা,গণিত ও প্রকৃতি তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। উল্লিখিত বিষয়সমূহের বাস্তবতা ও অস্তিত্বগত অবস্থা নিরূপণই হলো তাত্ত্বিক দর্শনের প্রধান কাজ।
আর ব্যবহারিক দর্শনে তাত্ত্বিক দর্শনে অর্জিত নীতির আলোকে মানুষকে কিভাবে গড়ে ওঠা উচিত,সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। অতএব,কার্যক্ষেত্রে আদর্শ পথ ও পদ্ধতির নির্দেশনা দিয়ে থাকে ব্যবহারিক দর্শন।
এখন আমরা যদি এ শ্রেণীবিন্যাসগুলোর প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে অবশ্যই বুঝাতে পারবো যে,প্রাচীনকালে সকল প্রকারের বিদ্যাই দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানও বিস্তৃতি লাভ করেছে। যার ফলে এখন আর একজনের দ্বারা সকল প্রকারের জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব নয়। তাই দর্শনের বিভিন্ন শাখাই আজ একেকটি স্বাধীন শাস্ত্রে রূপ নিয়ে আলাদাভাবে গড়ে উঠেছে। এজন্য এখন দর্শন বলতে গেলে কেবল স্রষ্টাতত্ত্বকেই বোঝানো হয়ে থাকে।
বর্তমান যুগে পাশ্চাত্যের কোন কোন দার্শনিক বিজ্ঞানকে দর্শনের মোকাবিলায় দাঁড় করিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁদের দৃষ্টিতে বিজ্ঞান হলো নিশ্চিত আর দর্শন হলো অনিশ্চিত বিদ্যা। তাই দর্শনের কাছে নিশ্চিত কিছু দাবি করা চলে না।৩ তাঁরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা পরীক্ষামূলক ও অভিজ্ঞতালব্ধ সকল বিদ্যাকে বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞান হিসাবে ধরেছেন। আর বর্তমান দর্শন বা স্রষ্টাতত্ত্ব যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা বা বস্তুগত পরীক্ষা বহির্ভূত তাই তাকে জ্ঞানের গণ্ডি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমাদের দৃষ্টিতে কোন বিষয়ের পরিচিতি লাভ করাই হচ্ছে জ্ঞান। সে পরিচিতির মাধ্যম বুদ্ধিবৃত্তি বা ইন্দ্রিয়শক্তি যা-ই হোক না কেন। দর্শন তো অজ্ঞতা নয়। বরং দর্শন আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের যুক্তিসংগত পরিচয় দিয়ে থাকে। কখনো কখনো এরূপ যুক্তিসংগত পরিচয় দেয়া অন্য সকল বিদ্যার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু তা-ই নয়,প্রাথমিকভাবে প্রতিটি শাস্ত্রই দর্শনের মুখাপেক্ষী।
দর্শনের মাধ্যমই বিশ্বজগৎ সম্পর্কে বিভ্রান্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি খণ্ডন করা হয়ে থাকে এবং প্রতিটি জ্ঞানের বিষয়বস্তু,সম্ভাবনা ও অস্তিত্ব নিয়ে একমাত্র দর্শনই আলোচনা করে থাকে। যেমন ধরুন,প্রাথমিক অবস্থায় আমরা যদি নিষ্প্রাণ বস্তুসত্তার অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে না পারি তাহলে পদার্থবিদ্যার (Physics) বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রই তৈরি হয় না। কেননা ভাববাদে (Idealism) বিশ্বাসীরা বিশ্বে বস্তুগত বাস্তবতায় অবিশ্বাসী। অর্থাৎ তাঁরা মনে করেন বিশ্ব বাস্তব অস্তিত্বশূন্য;তাই সবই খেয়াল অর্থাৎ অলীক কল্পনা মাত্র। ফলে যতক্ষণ পর্যন্ত এই দার্শনিক চিন্তাকে খণ্ডন করা না যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত পদার্থবিদ্যার বিষয়বস্তুরই বাস্তব অস্তিত্ব ঘটবে না। এজন্য প্রথমে দর্শনশাস্ত্রের মাধ্যমে ভাববাদকে খণ্ডন করে বাস্তববাদ (Realism) এসে বস্তুসত্তার বাস্তবতাকে প্রমাণ করার পর পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। বিষয়বস্তুশূন্য বা সংশয়যুক্ত বিষয়বস্তু নিয়ে কোন শাস্ত্র জ্ঞান বা বিদ্যার সারিতে দাঁড়াতে পারে না। ইসলামী দর্শন এ জাতীয় চিন্তাকে কখনই গ্রহণ করেনি,বরং অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
স্রষ্টাতত্ত্ব অবস্থান ও গুরুত্বের দিক থেকে অন্য সকল দর্শনের শীর্ষে অবস্থান করছে,যে কারণে স্রষ্টাতত্ত্বকে সর্বোচ্চ দর্শন বলা হয়। ল্যাটিন ভাষায় সর্বোচ্চ দর্শনকে বলা হয় অধিবিদ্যা (Metaphisics)।
অ্যারিস্টটল সর্বপ্রথম উপলব্ধি করলেন যে,এমন একটি বিষয় রয়েছে যা অন্য সকল শ্রেণীবদ্ধ জ্ঞানের (পদার্থ,গণিত,নীতিশাস্ত্র,সমাজবিজ্ঞান,যুক্তিবিদ্যা…) পরিধিতে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই এ জাতীয় বিদ্যাকে আলাদাভাবে আলোচনা করা উচিত। এই চিন্তার ওপর ভিত্তি করেই অনেকের ধারণানুযায়ী তিনিই সর্বপ্রথম অধিবিদ্যার (অস্তিত্বের অস্তিত্বগত অবস্থা) ওপর আলোচনা করেছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে অধিবিদ্যার অসাধারণ বিস্তৃতি ঘটেছে। তবে তিনিই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন যে,এই বিশেষ প্রকারের বিদ্যাকে একটি স্বাধীন বিদ্যায় রূপ দেয়া উচিত এবং তিনিই অন্য সকল বিদ্যার মাঝে অধিবিদ্যাকে একটি বিশেষ স্থান দেন। তবে তিনি কিন্তু এই বিশেষ প্রকারের বিদ্যার কোন নাম দেননি। পরবর্তীকালে অ্যারিস্টটল-এর রচনাসমূহ যখন একটি জ্ঞানকোষ আকারে একত্র করা হলো তখন ঐ বিশেষ প্রকারের বিদ্যা সংক্রান্ত আলোচনার অধ্যায়টি প্রকৃতিবিজ্ঞানের পর স্থান লাভ করে। এরই ওপর ভিত্তি করে,যেহেতু কোন নাম ছিল না তাই নাম দেয়া হয় Metaphisics অর্থাৎ ‘প্রকৃতি পরবর্তী’ বা অধিপ্রকৃতি নামে খ্যাতি অর্জন করে।
কিন্তু আস্তে আস্তে এই নামকরণের কারণটি হারিয়ে যায় এবং বহুল প্রচলন ও ব্যবহারের কারণে এ নতুন পরিভাষাটি দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে। উক্ত পরিভাষাটি আরবীতে (ما بعد الطبیعة) অনুবাদ হয়ে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে।
পরবর্তী সময়ে ঐ নামকরণের আসল কারণটি ভুলে গিয়ে ধারণা করা হয়,যেহেতু এখানে প্রকৃতি বহির্ভূত (স্রষ্টা,বুদ্ধিবৃত্তি…) কিছু বিষয়ের আলোচনা করা হয়ে থাকে তাই এ নাম দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টি বেশ কিছু দার্শনিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন ইবনে সিনা। তাঁদের কাছে যে প্রশ্ন জাগে তা হলো,এই নামটি Metaphisics অর্থাৎ ‘প্রকৃতি পরবর্তী’ বা ‘অধিপ্রকৃতি’ না হয়ে হওয়া উচিত অর্থাৎ ما وراء الطبیعة অর্থাৎ ‘প্রকৃতির পূর্বের বিষয়বস্তু’। কারণ অস্তিত্বের পর্যায়সমূহের পরম্পরায় স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রকৃতির পূর্বে অবস্থান করছে,আর স্রষ্টাতত্ত্বের পরে অবস্থান করছে প্রকৃতি।
যা হোক এ ক্ষেত্রে তথাকথিত কিছু দার্শনিকের আভিধানিক ও শাব্দিক অনুবাদের কারণে একটি ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে দর্শন জগতে। যে ভুলের সূত্র ধরে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা পরা প্রাকৃতিক (ما وراء الطبیعة) বা অতিপ্রাকৃতিক বিষয়বস্তুকে অধিপ্রকৃতির (ما وراء الطبیعة) সমান ধরেছেন।
এবার আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে আসি,সনাতনী জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ দর্শন অন্য সকল প্রকারের দর্শনের তুলনায় অধিক যুক্তিযুক্ত ও নিশ্চয়তামূলক। তাই তাঁদের মতানুযায়ী সর্বোচ্চ দর্শন হলো সমস্ত জ্ঞানের জনক। কেননা সমস্ত শাস্ত্র বিভিন্নভাবে এর মুখাপেক্ষী। এছাড়াও তাঁরা আরও অনেক যুক্তির ভিত্তিতে সর্বোচ্চ দর্শনকে ‘প্রকৃত দর্শন’ বলে নামকরণ করেছেন।৪ উল্লিখিত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে কখনো কখনো কেউ কেউ দর্শন শব্দটিকে কেবল এই বিশেষ প্রকারের দর্শনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন।
দর্শন চর্চার প্রয়োজনীয়তা
দর্শন শাস্ত্র চর্চার প্রয়োজনীয়তাকে আমরা দু’ভাবে বর্ণনা করতে পারি :
প্রথমত : প্রতিটি সত্যান্বেষী মানুষ তার স্বভাবগত বা সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জন্মের পর থেকে তার চারপাশে বিদ্যমান প্রতিটি বস্তুকে জানতে চায়। সে তার চলমান জীবনে প্রতিটি ঘটনা ও বস্তুর ক্ষেত্রে উদাসীন ও অমনোযোগী থাকতে পারে না। তাই তাকে সর্বক্ষণ বিভিন্ন পরিচিতি ও নির্বাচনের মধ্যে থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ : একটি আম গাছের কথাই ভাবুন। এই গাছটিকে যখন আমরা ধারণা করব যে,একটি নিষ্প্রাণ অনুভূতিহীন বৃক্ষ যা একমাত্র অন্যের ক্ষুধা নিবারণের জন্য তৈরি হয়েছে। তখন এ পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে আমরা তার ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব নির্ধারণ করব।
কিন্তু আমরা যদি গাছটির পরিচয় এভাবে অর্জন করি যে,এটি মহান প্রজ্ঞাবান স্রষ্টার বিশেষ একটি সৃষ্টি,আর প্রতিটি সৃষ্টিই সারাক্ষণ স্রষ্টার তাসবীহ পাঠে মশগুল৫ এবং আল্লাহর বিশেষ নির্দশনস্বরূপ। মহান প্রভু এ গাছের মাধ্যমে তার সৃষ্টির রিজিক প্রদান করে থাকেন এবং ঐশী শক্তি ও ঐশ্বর্যকে মানব জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।
এ জাতীয় ধারণা বা পরিচিতি লাভের কারণে আমাদের যে দায়িত্ব নির্ধারিত হবে,তা পূর্বোক্ত পরিচিতি থেকে উদ্ভূত দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মানুষ জানতে চায় সে কোথা থেকে এসেছে? বর্তমানে কোথায় আছে? এবং পরিশেষে তার জীবন যাত্রার পরিণতি কি হবে? সে কে? এ জাতীয় হাজারো প্রশ্নের উত্তর পেতে সে বিশ্ব-পরিচিতির প্রয়োজন অনুভব করে। এ সকল প্রশ্নের উত্তর বা বিশ্বের অস্তিত্ব সংক্রান্ত জ্ঞান ও পরিচিতির একমাত্র সর্বজনীন পদ্ধতি হলো দর্শনশাস্ত্র।
দ্বিতীয়ত : মানুষ বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন সম্পর্কহীন ভিন্ন কোন সৃষ্টি নয়। এমনকি বিশ্বও মানুষ থেকে সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন কোন অস্তিত্ব নয়। পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুর সাথে মানুষের প্রকৃত ও বাস্তব একটি সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ এ বিষয়টিও অনুভব করে যে,প্রতিটি বস্তুই তার জন্য সমান লাভজনক বা ক্ষতিকর নয়।
এই অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে বিদ্যমান অন্য সকল অস্তিত্বকে সঠিক পন্থায় ব্যবহার ও তা থেকে উপকৃত হওয়ার একমাত্র পথ হলো বিশ্ব-পরিচিতি। আর বিশ্ব-পরিচিতি নিয়ে একমাত্র দর্শনশাস্ত্রই আলোচনা করে থাকে।
বিশ্বজগতের কিছু কিছু বিষয় অমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে সুস্পষ্ট হলেও অন্য আরো অসংখ্য অস্তিত্বের রহস্য উদ্ঘাটন কিন্তু অতটা সাধারণ বা সহজ নয়। যে কারণে একই বাস্তবতা সম্পর্কে বিভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন।
অতএব,মানুষের এমন একটি জ্ঞান বা শাস্ত্রের প্রয়োজন যা দিয়ে সৃষ্টিজগতকে সে জানতে পারবে এবং অস্তিত্বের অবস্থা ও পর্যায় নিরূপণ করতে পারবে। এ জাতীয় জ্ঞান বা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা তখনই আরো অধিক অনুভূত হবে যখন আমরা বিশ্বাস করব যে,বিশ্বের সকল অস্তিত্ব বা বাস্তবতা পঞ্চেন্দ্রিয় কেন্দ্রিক নয়। কেননা যদি সমস্ত অস্তিত্বের রহস্য বা বাস্তবতা ইন্দ্রিয়কেন্দ্রিক হতো বা অনুভূতিশীল যন্ত্রের মাধ্যমে সরাসরি তাদের পরিচিতি লাভ সম্ভব হতো,তাহলে দর্শন-যে শাস্ত্র দ্বারা গভীর অদৃশ জগতের পরিচিতি ও সমস্যাসমূহ সমাধান করা হয়,তার প্রয়োজন পড়ত না।
কিন্তু বিশ্বের বিরাট অংশ ইন্দ্রিয় বহির্ভূত বিষয়,যেমন মানবাত্মা,ঐশীবার্তা,আদি,অনন্ত,ঐশীদূতগণ ও বিশ্বের শুরু এবং সমাপ্তি পরিচিতির জন্য এমন এক জ্ঞানের প্রয়োজন যা এ সকল অস্তিত্ব বা বিষয়ের রহস্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে। এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে,উল্লিখিত জ্ঞানই হবে বিশ্ব পরিচিতির মাপকাঠি,আর তা হলো দর্শনশাস্ত্র।