অথবা, দর্শনের ইতিহাসে মুসলিম দর্শনের গুরুত্ব কোথায়?
অথবা, মুসলিম দর্শন পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
অথবা, দর্শনের ইতিহাসে মুসলিম দর্শনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শন পাঠের উপযোগিতা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : জগতের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য এবং জীবনের সম্ভাবনাকে যুক্তির আলোকে স্বাধীন পর্যালোচনা করা হলো দর্শন। অন্তর্দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গির অভ্রান্ততা বিচারবিশ্লেষণের ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য দার্শনিক মানসিকতার পূর্বশত। একজন দার্শনিক স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মনোভাবের অধিকারী । তিনি জ্ঞান ও সত্যের সন্ধানে যুক্তিবিচার ও মুক্তবুদ্ধির দ্বারা
পরিচালিত হন। আর তাই জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানুসন্ধানের বিষয় হিসেবে দর্শনের ক্ষেত্র ব্যাপক ও বিস্তৃত। আর এই দর্শনের ক্ষেত্রে মুসলিম দর্শন পাঠের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
মুসলিম দর্শন পাঠের গুরুত্ব : জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি শুধু বিশেষ বিশেষ জ্ঞান লাভেই পরিতৃপ্ত হন না। একজন বিজ্ঞানী তার অনুসন্ধান পরিচালনা করে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। কিন্তু দার্শনিক তার অনুসন্ধান চালান সার্বিকভাবে। কেননা তিনি জগৎ ও জীবনকে বিশেষ দৃষ্টিকোণ হতে না দেখে সার্বিক দিক দিয়ে দেখেন। আর এ দৃষ্টিকোণ হতে বলা যায় যে,
দর্শনের ইতিহাসে যেমন পাশ্চাত্য দর্শনের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মুসলিম দর্শন ভারতীয় দর্শন, চৈনিক দর্শনেও গুরুত্বপূর্ণ। নি েএ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচিত হলো :
১. জ্ঞানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা : সপ্তম হতে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময় মুসলিম জাতির ইতিহাস এক স্বর্ণোজ্জ্বল গৌরবময় যুগ। সে সময় মুসলমান জাতি পার্থিব ঐশ্বর্যে এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের অনুশীলনে ও বিস্তারে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছিল। তারা পারস্য, সিরিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া হতে যে পুরাতন জ্ঞান লাভ করেছিল তা সম্পূর্ণভাবে নতুন করে ইউরোপে হস্তান্তরিত করেছিল। ইউরোপের মধ্যযুগকে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলা হয়। আর এ অন্ধকার যুগে মুসলমানরা তাদের দর্শনের আলোচনার মাধ্যমে জ্ঞানের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল ।
২. আধুনিক ইউরোপের চিন্তার ভিত্তি : আধুনিক ইউরোপের যে চিন্তাধারা তার ভিত্তি বলা যেতে পারে মুসলিম দর্শনকে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম দর্শন প্যারিসের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্যতম প্রবল শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল। ফ্রান্সিসকান মেলার মাধ্যমে মুসলিম দর্শন ইংল্যান্ডে প্রবেশ করেছিল। ১১০৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইবনে রুশদের গ্রন্থাবলি ল্যাটিন অনুবাদ পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রোজার বেকনের পরীক্ষণীয় মতবাদে আরবীয় চিন্তাবিদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল । তিনি আল-কিন্দিকে আলোক বিজ্ঞানের প্রথম লেখক হিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন।
৩. রেনেসাঁয় অবদান : ইউরোপের রেনেসাঁর মূলে মুসলিম দার্শনিকদের অবদান অনস্বীকার্য। যারা এ মতকে অস্বীকার করেন তারা আসলে আধুনিক দর্শনের যে ধারাবাহিক বিবর্তন এবং তার যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ শৃঙ্খল, তাকে অস্বীকার করেন। রেনেসাঁর যে মূলনীতি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা তা ইসলামে উচ্চারিত হয়েছে। ইসলাম ধর্মের মূলকথা হলো কারো প্রতি বৈষম্য নয়, বরং বিশ্বাসিগণ পরস্পরকে সহযোগী এবং স্বাধীনতা মেনে নিয়ে জীবনযাপন করতেন। তাই আমরা সহজেই বলতে পারি যে, মুসলিম দর্শনে রেনেসাঁ যথেষ্ট অবদান রেখেছে।
৪. নৈতিক মূল্যবোধকে উচ্চস্থান দান : ইসলামের মূলনীতি হতে উৎসারিত মুসলিম দর্শন সবসময়ই নৈতিক মূল্যবোধকে উচ্চস্থান দিয়েছে। মুসলিম দর্শন শুধু নিছক ভাববাদে পর্যবসিত হয় নি, বরং এ দর্শনে ভাববাদ, বস্তুবাদ, স্বজ্ঞাবাদ এর সমন্বয়ে এক নব্য চিন্তাধারা বিকশিত হয়েছে যা উচ্চ নৈতিক মানসম্পন্ন। জীবনের বাস্তব সমস্যা, সামাজিক
দ
ায়িত্ব ও কর্তব্য, আন্তর্জাতিক সমঝোতা প্রভৃতি জীবন কেন্দ্রিক বাস্তবধর্মী সমস্যাবলির আলোচনা মুসলিম দর্শন যুক্তিযুক্তভাবে করেছে।
৫. ইউরোপীয় মানবতাবাদের ভিত্তি : মানবতাবাদী চিন্তার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় চিন্তাধারার কথা চলে আসে। মানবতাবাদ বলতে বুঝায়, এ পৃথিবীতে মানুষকে স্থান এবং তার জীবনযাপনের অধিকার সম্বলিত যে নীতি তার চিন্তাধারাকে। পাশ্চাত্য দর্শনে মানবতাবাদ সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু আমরা একটু অনুসন্ধান করলে
দেখতে পাব যে, এর উৎসমূল ছিল মুসলিম চিন্তাবিদগণ। আর তাই দার্শনিক ইকবাল বলেছেন, আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের খোলসে আধুনিক ইউরোপের যে মানবতাবাদ তা নানাভাবে মুসলিম কৃষ্টির উন্নতি সাধন মাত্র।
৬. গ্রিক দর্শনের ঐতিহ্য রক্ষা : আরবীয় চিন্তাবিদগণ গ্রিক দর্শনের ঐতিহ্যকে অধ্যয়ন করেছেন। আমরা দেখি যে, আরবীয় খলিফারা এরিস্টটল, প্লেটো, গ্যালেন, হিপ্পরাস, প্লটিনাস প্রভৃতি চিন্তাবিদদের রচনাসমূহ রাষ্ট্রীয়ভাবে আরবি ভাষায় অনুবাদের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তারা এ অনুবাদ এবং তাদের দর্শন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে চেয়েছেন। শুধু তারা অধ্যয়ন নয়, এ সম্পর্কে টীকা ও ভাষ্যও রচনা করেছেন। তাই প্রাচীন প্লেটো, এরিস্টটল এবং নব্য প্লেটোবাদ সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য আমাদের আরবীয় চিন্তাবিদগণের টীকা ও ভাষ্য পাঠ গুরুত্বপূর্ণ ।
৭. চিকিৎসাশাস্ত্রে অবদান : ইবনে সিনার হাতে চিকিৎসাবিদ্যায় এতই উন্নতি ও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল যে, তার পরবর্তী ৫০০ বছর ধরে চিকিৎসাবিদ্যায় তিনিই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তার ‘কিতাবুল শিফা’ এক যুগান্তকারী গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি কোন একক ওষুধের ব্যবহার না করে নতুন ওষুধ তৈরির কথা বলেছেন। তাই বলা যেতে পারে যে, মুসলমানদের চিকিৎসাশাস্ত্রেও যথেষ্ট অবদান ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলমান চিন্তাবিদদের জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা এবং সে সম্পর্কে তাদের মতামতই মুসলিম দর্শন হিসেবে পরিচিত। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা পেতে হলে তুলনামূলক আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। আর এ দিক থেকে অন্যান্য দর্শন যেমন- গ্রিক দর্শন, ভারতীয় দর্শনের সাথে মুসলিম দর্শন পাঠও
সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।