মুসলিম দর্শনের স্বরূপ আলোচনা কর। মুসলিম দর্শনের সম্ভাব্যতার বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তিগুলো তুমি কিভাবে খণ্ডন করবে?

অথবা, মুসলিম দর্শনের প্রকৃতি আলোচনা কর। এর দর্শনের সম্ভাব্যতার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ খণ্ডন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মুসলিম দর্শনের স্বরূপ আলোচনা করতে হলে আমাদের প্রথমে জেনে নেওয়া দরকার মুসলিম দর্শন কি? মুসলিম দর্শনের মূল ভিত্তি হল কুরআন ও হাদিস। মুসলিম দর্শন হল মুসলিম জাতির চিন্তা ও চেতনার ধারা। এ দর্শন সামগ্রিকভাবে মুসলিম জগৎ ও জীবনকে ব্যাখ্যা করে। মুসলিম দর্শন বলতে আমরা জীবন ও মূল্যবোধ বিষয়ক এমন একটি আদর্শকে বুঝবো, যা কুরআন ও হাদিসে উত্থাপিত এবং যা মুসলিম জাতির ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সে আদর্শ থেকে বিকশিত । এবার আমরা মুসলিম দর্শনের স্বরূপ আলোচনা করব।
মুসলিম দর্শনের স্বরূপ : প্রত্যেক জাতিই তাদের নিজস্ব চিন্তাধারার মাধ্যমে জীবনের মৌলিক মুল্য নিরূপন এবং জগৎ রহস্য উদঘাটন করে এবং সে অনুসারে তাদের জীবনের গতি নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু মুসলিম জাতি একটি স্বতন্ত্র জাতি সেজন্য মুসলিম জাতির জীবনধারা এবং জীবন ও জগৎ সম্পর্কীয় মূল্যবোধ নির্ধারন সম্পর্কে সুস্পষ্ট চিন্তাধারা ও অভিমত রয়েছে। এ সুস্পষ্ট চিন্তাধারা ও অভিমতই মুসলিম জাতির চিন্তাধারার সুস্পষ্ট দর্শন। মুসলমানগণ সভ্যতার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ছাপ রাখেন এবং এমন এক সংস্কৃতির জন্ম দেন যা যে কোন জাতির জন্য গৌরবজনক। বিশ্বে অন্য জাতিসমূহ যখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তখন তারা জ্ঞানের আলোকবর্তিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন। বহু শতাব্দী যাবৎ তারা জ্ঞান ও সংস্কৃতির দ্বারা বিশ্বসভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখেন। মুসলিম পণ্ডিতদের রচিত সব সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনের মূলে রয়েছে তাদের ধর্ম ইসলাম। মানবজাতির সাধারণত উত্থান ও অগ্রগতির সাথে ইসলাম সংগতি রক্ষা করে চলে। ইসলাম লব্ধ জ্ঞানকে সুসংবদ্ধ করে এবং জ্ঞান প্রসার ও প্রচারে নিজস্ব অবদান রাখে। আর মুসলিম দর্শনের বেশির ভাগই সৃষ্টি হয়েছে ইসলামকে কেন্দ্র করে। মুসলিম দর্শন মূলত কুরআন ও হাদিস অনুসারে সৃষ্ট দর্শন, আর মুসলমানগণ কুরআন ও হাদিস অনুসারে পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এবং জীবনের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের ধর্মকে বুঝার যে বিচারশীল আন্তরিক প্রয়াস চালিয়েছে তাই ক্রমশ গড়ে তুলেছে মুসলিম দর্শন। আর ডিউটসে পবিত্র কুরআনের শিক্ষাকে পরিব্যক্ত করে বলেছেন, “পবিত্র কুরআন হল সে মহাগ্রন্থ যার দ্বারা আরবগণ জ্ঞানালোক ধারণ করেন এবং অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন মানবজাতিকে পথ প্রদর্শনের জন্য ইউরোপে রাজন্যের ন্যায় আগমন করে।” হাদিস সম্পর্কে নবী (দ) বলেছেন, “প্রথম যে বস্তু সৃষ্টি করা হয়েছে তা হচ্ছে প্রজ্ঞা এবং প্রজ্ঞা ও বুদ্ধির চেয়ে আল্লাহ উত্তম কিছু সৃষ্টি করেন নি।” তাই আমরা বলতে পারি, কুরআন ও হাদিস নির্ভর শক্তিশালী দর্শনই হল মুসলিম দর্শনের স্বরূপ। মুসলিম দর্শনের সম্ভাব্যতার বিরুদ্ধে আপত্তিগুলো : পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ মুসলিম দর্শনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছেন। তারা মুসলিম দর্শনের সম্ভাব্যতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। তাদের মতে মুসলিম দর্শন বলে কিছু নেই । আলফ্রেড গুইলাম বলেছেন, “পাশ্চাত্য সাহিত্যের মাঝে আরবি দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়।” ডিং বত্তর বলেছেন, “গ্রিক ভাষা হতে অনূদিত গ্রন্থাবলির উপর নির্ভর করে মুসলিম দর্শন সর্বদা সংগ্রহ হিসেবে চলে এসেছে। এর ইতিহাসের গতিতে সৃষ্টির পরিবর্তে ছিল সংগ্রহ প্রক্রিয়া। মুসলিম দর্শনকে সত্যিকার অর্থে দর্শন বলে আমরা আদৌ অভিহিত করতে পারি না।” মুসলিম দর্শনের বিরুদ্ধে এসব কাল্পনিক অভিযোগ বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এ অভিযোগগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এ অভিযোগগুলো ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে পাশ্চাত্য অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। শুধু তাই নয়, এ অভিযোগগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিদ্বেষপ্রসূত। এবার আমরা অভি যোগগুলোর অসারতা প্রমাণে সচেষ্ট হবো ঃ
১. ইসলাম ধর্ম বল প্রয়োগে প্রচারিত : ইসলাম ধর্ম পেশিশক্তি দ্বারা বা বল প্রয়োগের দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল বলে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ যে অভিযোগ আনয়ন করেন তার পশ্চাতে ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ দাঁড় করাতে পারে নি । ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে “ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই, সত্য ভ্রান্তির পথ থেকে আপন দীপ্তিতে দীপ্তমান।” আবার আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- “তোমাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে তাদের সাথে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর, কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করো না। কারণ আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করে না।” বিখ্যাত ইতিহাসবেত্তা হার্ডি বলেছেন, “যারা বলেছেন যে ইসলাম ধর্ম তলোয়ার দ্বারা বা বল প্রয়োগে প্রচারিত, তারা প্রকৃতপক্ষে শক্তি ও ধর্মান্তর শব্দ দুটোর অর্থ জানে না।” কাজেই ইসলাম ধর্ম যে শক্তি ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রচারিত এ অভিযোগ ঠিক নয়।
২. মুসলমানদের অনুধ্যানিক চিন্তার অভাব : মুসলমানদের অনুধ্যানিক চিন্তার অভাব এ অভিযোগের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পৃথিবীর যেসব জাতির স্বর্ণময় কীর্তি সম্পর্কে ইসলাম সাক্ষ্য দেয় মুসলমান জাতি তাদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক মানুষের মনকে আলোড়িত করে এমন কোন প্রশ্ন নেই যা আরবরা দার্শনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেন নি। মুসলমানদের সাহিত্য, শিল্পকলা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা পাশ্চাত্য জগতে তার অজ্ঞানতার অন্ধকার হতে রক্ষা করতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।
৩. কুরআন ও ইসলামের স্বাধীন চিন্তার অবকাশ নেই : কুরআন ধর্মবিশ্বাসে তার অনুসারীদের নিকট থেকে অন্ধ অনুকরণ ও আনুগত্য দাবি করে। সুতরাং এখানে স্বাধীন চিন্তার অবকাশ নেই— পাশ্চাত্য দার্শনিকদের এ অভিযোগে পবিত্র কুরআন ও কুরআনীয় শিক্ষা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই পরিচয় বহন করে। একজন ইউরোপীয় মনীষী উল্লেখ করেন, কুরআনের মহান গুরুত্ব এখানে যে, কুরআন ও হাদিসের পঠন পাঠনে এটা যতটুকু গুরুত্ব প্রদান করেছে, অন্যান্য বিজ্ঞানের বেলায়ও ততটুকু গুরুত্ব আরোপ করেছে।”

৪. আরবগণ যুদ্ধ ও কলহপ্রিয় : আরবগণ যুদ্ধ ও কলহপ্রিয় জাতি। সুতরাং তাদের মধ্যে দার্শনিক সুলভ মন মানসিকতা নেই- পাশ্চাত্য দার্শনিকদের এরূপ অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব যে, সূক্ষ্ম চিন্তা তত্ত্বে জিজ্ঞাসা এবং সৃজনশক্তির ক্ষেত্রে আরব জাতির গৌরব আজও অক্ষুণ্ন আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের
অগ্রগতির স্রোত মধ্যযুগে যখন পতনোম্মুখ তখন মুসলিম মনীষী ও চিন্তাবিদই সে স্রোতধারাকে অব্যাহত রাখেন।
উপসংহার : সবশেষে আমরা বলতে পারি, মুসলিম চিন্তাবিদগণ কুরআন ও হাদিসকে ভিত্তি করে জীবন- জিজ্ঞাসার যে বিশদ আলোচনা ও পর্যালোচনা করেছেন তাই মুসলিম দর্শন রূপ লাভ করেছে। তাই মুসলিম দর্শনকে ইউরোপীয় দর্শনের সাথে একাত্ম করে দেখা ঠিক হবে না। কারণ মুসলিম দর্শন কেবল মুসলিম দর্শনের ন্যায়ই এবং অন্য কিছু নয়। মুসলিম দর্শন বলতে কোন দর্শন নেই, এর কোন সম্ভাবনা নেই এ কথা কোনভাবেই বলা যায় না। মুসলিম দর্শন বলতে অবশ্য একটা দৰ্শন আছে যা স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্যে মহীয়ান ও ভাস্বর ।