অথবা, মুসলিম দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ বর্ণনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যা জান লেখ।
অথবা, মুসলিম দর্শনের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায় উল্লেখপূর্বক মন্তব্য দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : কোন বিশেষ যুগের কিংবা কোন বিশেষ ব্যক্তির দর্শন প্রধানত তার পরিবেশ, তার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। ইতিহাসের অন্যান্য জাতির ন্যায় ইসলাম ধর্মের অনুসারীরাও যুগ যুগ ধরে এক বিশেষ পদ্ধতিতে তাদের নিজস্ব জীবনদর্শন প্রণয়নের চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। এ প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত থাকাকালে সত্যের স্বরূপ বিষয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে যে কোন মতপার্থক্য দেখা দিয়ে থাক না কেন, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তাদের মূল বিশ্বাস ও নীতি প্রতিষ্ঠিত ছিল কুরআন ও হাদিসের রচিত দৃঢ় ভিত্তির উপর।
মুসলিম দর্শন : মুসলিম দর্শন বলতে বুঝায় এমন এক মূল্যাবধারণ ও জীবনদর্শনকে যার উৎপত্তি কুরআন ওহাদিস থেকে এবং যা হয়েছে পরবর্তীকালে আবির্ভূত বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের জগৎ ও জীবন জিজ্ঞাসার ফলশ্রুতিতে। পরবর্তীতে পরিবেশ ও পরিস্থিতি এবং জীবনের নতুন নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে মুসলমানেরা তাদের ধর্মকে বুঝার যে বিচারশীল আন্তরিক প্রয়াস চালিয়েছে, তাই ক্রমশ গড়ে তুলেছে মুসলিম দর্শন। জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও সমস্যার
ব্যাখ্যায় তাদের প্রেরণা যুগিয়েছে ধর্মীয় মতাবলি এবং ধর্মীয় মতাবলিও আবার পরিবর্তিত হয়েছে বিরাজমান অভ্যন্তরীণ ও
বহিরাঙ্গিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে। মুসলিম দর্শন কথাটি একটি ব্যাপক নামের নির্দেশক।
মুসলিম দর্শনের ক্রমবিকাশ : প্রাক-ইসলামি যুগে আরববাসী নানাপ্রকার সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার ও বর্বরতায় নিমজ্জিত ছিল। পৌত্তলিক আরবরা ছাড়াও সে যুগে বহু ইহুদি ও খ্রিস্টান বসবাস করতো। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আহলেকিতাব হলেও তারা ছিল নীতিভ্রষ্ট। ইহুদিরা ‘জাহোভা’কে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা হিসেবে গণ্য করতো; আর খ্রিস্টান ছিল ‘ত্রিত্ববাদে’ বিশ্বাসী। ফলে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে আরবরা ছিল বিশৃঙ্খল জাতি। সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকেও আরবরা এত নি পর্যায়ে নেমে এসেছিল যে, তখন স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া সে জাতির পরিত্রাণের কোন উপায় ছিল না।।হিট্টির ভাষায়, “মহান ধর্মীয় ও জাতীয় নেতার আবির্ভাবের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত ছিল, আর সময়ও ছিল যথোপযুক্ত।” ঠিক সে সময়ই সমগ্র বিশ্বের রহমতস্বরূপ হযরত মুহাম্মদ (স) আগমন করেন, আর প্রচার করলেন তৌহিদের বাণী। ইসলাম ধর্ম আল্লাহরই মনোনীত সর্বশেষ ধর্ম। নিম্নে মুসলিম দর্শনের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
মুসলিম দর্শন ও ইসলামি দর্শনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, একথা সত্য। তবে ইসলাম দর্শনের উপর ভিত্তি করেই মুসলিম দর্শনের উদ্ভব। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবির্ভাব মুসলিম চিন্তাধারাকে সামনের দিকে বিপুল গতিবেগ প্রদান।করেছিল। মহানবী (স) এর ওফাতের পর ইসলামে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে।।হযরত মুহাম্মদ (স) মৃত্যুর পূর্বে তাঁর কোন প্রতিনিধি নির্বাচিত করে যান নি। ফলে তাঁর মৃত্যুর পরেই প্রতিনিধিত্বের দাবিতে বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব ঘটে এবং অবশেষে আবুবকর (রা) এর খলিফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আশু সমস্যার সমাধান হয়ে যায় এবং ইসলামি গণতন্ত্র জয়লাভ করে। খিলাফতের অবসানে উমাইয়া
রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চিন্তাবিদেরা বিভিন্ন যুক্তি ও বিচারের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার আলোকে নতুন সমস্যাবলির ব্যাখ্যা দানে প্রয়াসী হন। আরবের বাইরে ইসলাম ধর্ম প্রচারের ফলে বিভিন্ন জাত
ির বিজাতীয় চিন্তাধারা মুসলমান জাতির মানস জগতে প্রবাহিত হতে থাকে। কোনপ্রকার পর্যবেক্ষণ ছাড়াই কুরআন ও আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হযরত মুহাম্মদ (স) বিশ্বাসীদেরকে জীবনের সমস্যাবলি, প্রজ্ঞা, সামাজিক প্রথা ও স্বজ্ঞার সাহায্যে উপদেশ দেন।পরবর্তী সময়ে মুসলিম চিন্তাবিদগণ আকল, নফল ও কাশফের উপর অত্যধিক মনোযোগ দেয়ায় তিনটি।চিন্তাগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এ গোষ্ঠীগুলো হলো মুতাজিলা, আশারিয়া এবং সুফি। এ তিনটি গোষ্ঠী তিনভাবে জীবনের সমস্যার সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মুতাজিলা চিন্তাবিদগণ প্রজ্ঞার সাহায্যে, আশারিয়া চিন্তাবিদগণ সামাজিক প্রথার সাহায্যে এবং সুফিরা অতীন্দ্রিয় অনুভূতির মাধ্যমে। মহানবী (স) এর মৃত্যুর পর নবুয়তের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। জীবনের নতুন নতুন সমস্যার সমাধানের জন্য মুসলিম চিন্তাবিদগণ কুরআন ও হাদিসের নতুন নতুন ব্যাখ্যা প্রদানে সচেষ্ট হন। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য তারা কুরআন ও হাদিস।ব্যাখ্যার সময় ইজতিহাদ বা গবেষণার শরণাপন্ন হন। মুসলিম জাতির ক্রমবিকাশে ইজতিহাদ মুসলিম জাতির।জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করেছিল।
ইসলামের প্রথম দিকে মুসলমানগণ ধর্মপ্রচার ও পালনেই বিভোর ছিল। মধ্যযুগের দিকে মুসলমান জাতি জ্ঞানবিজ্ঞানে, দর্শনে, স্থাপত্যে ও সংগীতে সুউচ্চ আসন লাভ করেছিল। সৃষ্টিশীল জাতি হিসেবে মুসলমান জাতি বাইরে থেকে যতটুকু নিয়েছে তার চেয়ে দিয়েছে অনেক গুণ বেশি। পারস্য বিজয়ের পর সেদেশের বহু লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। সেদেশের ধর্মতত্ত্ববিদরা যখন ইসলামের ব্যাখ্যা দেন তখন তাদের দেশীয় সভ্যতা কৃষ্টির আলোকেই তা দেন। ফলে ইসলামি চিন্তাধারায় তাদের ভাষা ও কৃষ্টির অনুপ্রবেশ ঘটে। আব্বাসীয় খলিফাদের রাজত্বকালে ভারতীয় চিন্তাধারার সাথে মুসলমানদের চিন্তাধারার মিশ্রণ ঘটে। মুসলিম দর্শনের ক্রমবিকাশে প্রাকইসলামি ধারণা যেমন অদৃষ্টবাদ এর ধারণা কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে।
মুসলিম দর্শনের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে রের প্রভাব যতটুকু কার্যকরী হয়েছে তার মধ্যে গ্রিক দর্শনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। গ্রিক দর্শনের মধ্যে পিথাগোরাস, প্লেটো, এরিস্টটল ও নব্য প্লেটোবাদীদের দর্শন মুসলিমদার্শনিকদের দর্শনচিন্তার রসদ সরবরাহ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মানবজীবনের ইহকালের ও।পরকালের এমন কোন বিষয় নেই যা পবিত্র কুরআন বা হাদিসে বর্ণিত হয় নি। এজন্যই কুরআন এবং হাদিসকে ইসলামি জীবন ব্যবস্থার মূল উৎস হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কুরআন ও হাদিস একদিকে যেমন ইসলামি জীবনের বুনিয়াদ পত্তন করেছে, অন্যদিকে।তেমনি জ্ঞানীগুণীদের জন্য অনুধ্যানের খোরাকও যুগিয়েছে। এ ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত মুসলিম দর্শন।