অথবা, মুসলিম দর্শনের অভ্যন্তরীণ উৎসসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, মুসলিম দর্শনের অভ্যন্তরীণ উৎস সম্পর্কে যা জান আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সত্যের স্বরূপ উদঘাটন করা এবং সত্য সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের প্রয়াসই হচ্ছে দর্শন। আর মুসলিম দর্শন হলো মুসলিম জাতির চিন্তা ও চেতনার ধারা। মুসলমানগণ আদি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তাদের চিন্তাধারার এক অব্যাহত স্রোত রক্ষা করে চলেছেন। প্রাচীন ও আধুনিক চিন্তাধারার মধ্যে সমন্বয় ও যোগসূত্র স্থাপন করে তাঁরা বিশ্ব ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন।
মুসলিম দর্শনের অভ্যন্তরীণ উৎস : মূলত কুরআন ও হাদিসের উপর ভিত্তি করেই মুসলিম দর্শন গড়ে উঠেছে। আর কুরআন ও হাদিসকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য ইজমা ও কিয়াসের সৃষ্টি হয়েছে। তাই বলা যায়, মুসলিম দর্শনের অভ্যন্তরীণ উৎস ৪টি। যথা :
আল কুরআন,
হাদিস,
ইজমা ও কিয়াস এবং
ইজতিহাদ।
১. আল কুরআন : আল কুরআন এমন এক মহাগ্রন্থ, যার সাথে সত্যিকারভাবে মানুষের প্রসার বা দর্শনের কোন বিরোধ নেই। যে আয়াত প্রথম অবতীর্ণ হয়, তাতে বলা হয় যে, “পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দেন এবং বস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানদান করেন (সুরা ৯৬, আয়াত, ৪)।” তাছাড়া কুরআনের মধ্যে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সেখানে আমাদের পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনাবলি যেমন- দিবারাত্রি, ঋতুর পরিবর্তন, গ্রহ নক্ষত্র, জোয়ারভাটা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। কুরআন সম্পর্কে আলোচনার প্রেক্ষিতে মুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা School এর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমরা নিঃসন্দেহে কুরআনকে মুসলিম দর্শনের প্রধান উৎস হিসেবে বলতে পারি।
২. হাদিস : কুরআনের মত হাদিসও মুসলিম দর্শনের অন্যতম মূল উৎস হিসেবে পরিগণিত। কুরআনের মতো জ্ঞানবিকাশে হাদিসের যথেষ্ট অবদান আছে। হুজুরে পাক (স) বলেছেন, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর উপর বিদ্যার্জন ফরজ। জ্ঞান ও সত্যের প্রতি ঐকান্তিক কামনা ও মনোনিবেশ এবং সর্বাত্মক বিনয় আত্মনিবেদনের মনোবৃত্তিই তার শিক্ষার ভিত্তি। তিনি তার সাহাবাগণকে বিচার বিশ্লেষণের চর্চা ও অনুশীলন করতে সবসময় উদ্বুদ্ধ করতেন। পবিত্র কুরআন যেমন দার্শনিক চিন্তার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, তেমনি হাদিসও মুসলমানদের দার্শনিক চিন্তার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
৩. ইজমা ও কিয়াস : মানুষের জ্ঞান সীমিত। তাই তার পক্ষে কিছু উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না। কুরআন সম্পর্কিত জটিল বিষয় সম্পর্কে হাদিসে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আবার হাদিসে যেসব বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে তার সম্পর্কে সমাধানের লক্ষ্যে ঐকমত্যের কথা হাদিসেই বলা হয়েছে। আর এ ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে ইজমা ও কিয়াস। তাই আমরা বলতে পারি
যে, ইজমা ও কিয়াস কুরআন ও হাদিসের উপর প্রতিষ্ঠিত। ইজমা ও কিয়াস মুসলিম দর্শনের বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে ।
৪. ইজতিহাদ : ইজতিহাদ হলো ইসলামের গতির নিয়ম। প্রতি মুহূর্তে আমরা নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় যে, সেগুলোর সমাধান হাদিসে নেই। তাই সে বিশেষ পরিস্থিতিতে কুরআন ও হাদিসের সঠিক প্রয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। আর একে বলে ইজতিহাদ, যা মুসলিম দর্শনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলিম দর্শনের মূল উৎস হচ্ছে কুরআন ও হাদিস। পরবর্তীতে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে মূল ভাবধারা বিভিন্ন খাতে বিকাশ লাভ করেছে। পবিত্র কুরআন অনুসারে মানুষ হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। জ্ঞান অনুশীলন করা তার কর্তব্য বরং জ্ঞানই তার পূর্ণতা। সুতরাং অভ্যন্তরীণ উৎসের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।