অথবা, মুসলিম দার্শনিকরা কোন কোন চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ কর।
অথবা, মুসলিম দার্শনিকগণ অন্যান্য দর্শন দ্বারা কতটুকু প্রভাবিত হয়েছেন, আলোচনা কর।
অথবা, মুসলিম দার্শনিকদের উপর অন্যান্য দর্শনের প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : জ্ঞানানুশীলন ও সত্যানুসন্ধানের বিষয় হিসেবে দর্শনের ক্ষেত্র এত ব্যাপক যে, এর কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন সম্ভব নয়। তবে দর্শন সম্পর্কে আমরা বলতে পারি যে, জগৎ ও জীবনের মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে আমাদের যৌক্তিক ও বিশ্লেষণী যে দৃষ্টিভঙ্গি তাই দর্শন। মৌলিক সমস্যা বলতে বুঝায় এমন সমস্যা, যা সব মানুষের কাছে
একটি জানার বিষয়। যেমন- মূল্য কি? সত্য কি? ভালো কি? মন্দ কি?। তাই আমরা দেখি যে, এসব সমস্যা নিয়ে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা যেমন ভাবিত হয়েছেন তেমনি ভাবিত হয়েছেন মুসলিম দার্শনিকরা। ঐতিহ্যগতভাবে তারা কুরআন ও হাদিসের আলোকে তাদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে সুচিন্তিত মত দিয়েছেন।
মুসলিম দর্শন অন্যান্য দর্শন দ্বারা প্রভাবিত কী না : মানুষ তার চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগায় জগৎ ও জীবনকে ভালোভাবে জানার জন্য। আর এ জানার জন্য সে জানা বিষয় হতে অজানা বিষয়ে উপনীত হয়। ভারতীয় দার্শনিকদের ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে, তারা কোন বিশেষ সমস্যার ক্ষেত্রে প্রথমে অন্যান্য দার্শনিকদের মত আলোচনা করেছেন, পরে সে অনুসারে সে বিষয় সম্পর্কে নিজস্ব মত, পাল্টামত দেন। নি েএ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. গ্রিক দর্শনের প্রভাব : মুসলিম দর্শনের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে বাইরের প্রভাব যতটুকু কার্যকরী হয়েছে তার মধ্যে গ্রিক দর্শনের প্রভাব অগ্রগণ্য। গ্রিক দর্শনের পিথাগোরাস, প্লেটো, এরিস্টটল ও নব্য প্লেটোবাদীদের দর্শন মুসলিম দার্শনিকদের দর্শন চিন্তার রসদ সরবরাহ করে। খলিফা আল মামুনের সময়েই মুসলমানদের মধ্যে গ্রিক দর্শন পঠনপাঠন
শুরু হয় । শুধু তাই নয়, কয়েকটি বিশেষ গ্রন্থ আরবিতে ভাষান্তরিত হয়। আর এ সময়েই ফালাসিফা চিন্তাগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। তবে মুসলিম চিন্তাবিদগণ তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন নিজেদের স্টাইলে। সমগ্র মধ্যযুগে মুসলমানরা জ্ঞানবিজ্ঞানে, দর্শনে, স্থাপত্যে, সংগীতে, সংস্কৃতিতে সুউচ্চ আসন লাভ করেছিল। আধুনিক ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শন পরম শ্রদ্ধার সাথে তাদের মৌলিক ও যুগান্তকারী অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। তাই মধ্যযুগের গতিশীল, সৃষ্টিশীল জাতি হিসেবে মুসলিম চিন্তাবিদগণ বাহির হতে যা নিয়েছে তার চেয়ে দিয়েছেন অনেক বেশি। বলা হয়ে থাকে, আলেকজান্ডারের অভিযানের পর গ্রিক চিন্তাধারা প্রাচ্যের দেশসমূহে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর রাজ্যসমূহ সেলুকাস ও টলেমির ন্যায় দু’ভাগে ভাগ করে নেন। এশিয়া মহাদেশের রাজ্যগুলো
সেলুকাসের ভাগে পড়ে এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন সেলুসিয়া ও এন্টিওক গ্রিক শিক্ষা ও কৃষ্টির কেন্দ্রে পরিণত হয়। টলেমির অধীনে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক শিক্ষার অপর কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। হুজুরে পাক (স) এর ইন্তেকালের অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞান শিক্ষার কেন্দ্রগুলো মুসলমানদের শাসনাধীনে চলে আসে এবং এর ফলে মুসলমানরা গ্রিক চিন্তার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসে। আব্বাসীয় শাসনামলে আল
মামুনের রাজত্বকালে বিভিন্ন গ্রিক গ্রন্থ অনূদিত হয়। তবে উল্লেখ্য যে, মুসলমানরা সিরীয় ভাষাভাষী নব্য প্লেটোবাদীদের থেকে জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শন সম্পর্কে অবহিত হন।
২. পারস্যের প্রভাব : পারস্য জয়ের পর মুসলমানরা পারস্য চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসে। পারস্যের অধিবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু সবসময় সব বিষয়ে যে তারা এ ধর্মের প্রতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুগত ছিল তা বলা চলে না। আরবদের চরিত্রে
তখন যুক্ত হয়েছিল এক নতুন জাতির তরতাজা শক্তি ও নতুন ধর্মান্তরিতদের অগ্নিময় উদ্যম। অপরদিকে, পারস্যবাসী ছিল এক প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির গর্বে গর্বিত অলস জাতি। ফলে দেখা যায় যে, সমাজের উচ্চস্তরের অধিকাংশ পারসীয় ছিলেন মর্যাদা সচেতন এবং নতুন ধর্মের অনুশাসন ও আনুষ্ঠানিকতার প্রতি উদাসীন। প্রাচীন প্রথা ও ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তাদের এক অব্যাহত আন্তরিক সহানুভূতি। এ কারণেই ইসলামে তারা প্রয়োগ করে তাদের ফেলে আসা ধর্ম ও ঐতিহ্যের প্রাচীন ধারণা। আমরা তাই দেখি যে, ইসলামি চিন্তাধারায় তাদের প্রথা ও ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটে । শিয়া সম্প্রদায়ের দর্শনে এবং সুফি দর্শনের পরবর্তী বিকাশে কিছুটা পারসিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ দিক থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভবের জন্য পারসিক প্রভাবকেই দায়ী করা চলে। কিন্তু সুফি মরমিবাদে পারসিক প্রভাব রয়েছে বলা চলে না। কেননা সুফি মত ও পথ কুরআন ও হাদিসে নির্দেশিত। ফলে সুফি দর্শন পারসিক প্রভাব বর্জিত।
৩. ভারতীয় প্রভাব : অন্যান্য যেসব বিষয় মুসলিম দর্শনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেছিল সেগুলোর মধ্যে ভারতীয় প্রভাবের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে ভারতীয় চিন্তার মূল স্রোতসমূহ মুসলমানদের কাছে পৌছার পরবর্তী এক পর্যায়ে বিশেষত আব্বাসীয় শাসনামলে ইসলামে দরবেশ ভ্রাতৃত্ব ও মরমি ভাবধারার উদ্ভবের মূলে ছিল ভারতীয় প্রভাব। আব্বাসীয় খলিফাদের রাজত্বকালে ভারতীয় চিন্তাধারার সাথে মুসলমানদের যোগাযোগ ঘটে। বলা হয়ে থাকে, ইসলামের মরমি ও দরবেশী ভাবধারা ভারতীয় প্রভাব হতে উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু আমরা পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব যে, ইসলামি মরমিবাদে পারসিক প্রভাব যেমন নেই তেমনি নেই ভারতীয় প্রভাবও নেই। কেননা বৌদ্ধ দর্শনে নির্বাণ ও সুফি দর্শনের ফানা এক জিনিস নয়। প্রথমটি যেখানে নঞর্থক সেখানে দ্বিতীয়টি সদর্থক। ফলে আমরা বলতে পারি যে, মুসলিম দার্শনিকরা অন্যান্য চিন্তা দ্বারা বিশেষ করে ভারতীয় চিন্তাবিদদের সাথে পরিচিত হয়েছেন, কিন্তু তার দ্বারা পুরোপুরি প্রভাবিত হয়েছেন তা বলা চলে না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে তা হতে শিক্ষালাভ করে থাকে। শুধু তাই নয়, একটি জাতির সামগ্রিক বিকাশের জন্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এ উভয় দিকের বিকাশের প্রয়োজন। মহামতি এরিস্টটলের মতে, কি দার্শনিক, কি সংস্কৃতি চর্চাকারী সকলেরই দুটি জিনিস প্রয়োজন- ১. সম্পদ ২. অবসর। তাই অর্থনীতি ও সুনীতি উভয়ের যুগপৎ চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমেই সামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতি সম্ভবপর হয়ে উঠবে।