অথবা, প্রত্যক্ষ সম্পর্কে মীমাংসকদের মত আলোচনা কর।
অথবা, প্রত্যক্ষ সম্পর্কে মীমাংসা মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, প্রত্যক্ষ প্রমাণ সম্পর্কে মীমাংসা দার্শনিকদের অভিমত ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন আস্তিক স্কুলসমূহের মধ্যে মীমাংসা দর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মহর্ষি জৈমিনি মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে মীমাংসা দর্শনের আর এক নাম ‘জৈমিনি দর্শন’ । মীমাংসা দর্শন বেদের পূর্বকাণ্ড বা কর্মকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। আলোচনার সুবিধার্থে মীমাংসা দর্শনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : ১. জ্ঞান (Knowledge) ২. তত্ত্ব (Metaphysics) এবং ৩. নীতি ও ধর্ম (Ethics and Religion)। প্রমাণ হলো যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালি বা উপায় । জৈমিনির মতে, প্রমাণ তিন প্রকারের। যথা : ১. প্রত্যক্ষ, ২. অনুমান ও ৩. শব্দ। কিন্তু প্রভাকরের মতে প্রমাণ পাঁচ প্রকারের। যথা : ১. প্রত্যক্ষ, ২. অনুমান, ৩. শব্দ, ৪. উপমান ও
৫. অর্থাপত্তি। কুমারিল ভট্ট প্রভাকর মিত্র প্রদত্ত পাঁচ প্রকার প্রমাণের সাথে আর একটি প্রমাণ যোগ করেন। সেটি হলো অনুপলব্ধি । সুতরাং কুমারিলের মতে প্রমাণ ছয় প্রকার। যথা : ১. প্রত্যক্ষ, ২. অনুমান, ৩. শব্দ, ৪. উপমান, ৫. অর্থাপত্তি এবং ৬. অনুপলব্ধি। নিম্নে মীমাংসা দর্শনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ আলোচনা করা হলো :
প্রত্যক্ষ (Perception) : মীমাংসা মতে, কোন সৎ (অস্তিত্বশীল) বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটলে যে জ্ঞান হয় তাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ দুই প্রকারের। যথা :
(ক) নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ (Indeterminate Perception) ও (খ) সবিকল্প প্রত্যক্ষ (Determinate Perception)।
ক. নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ (Indeterminate Perception) : নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ হলো বস্তুর নিছক অনুভূতি। বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়ের যখন সংযোগ ঘটে প্রথমে বস্তু সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট চেতনার উদ্ভব হয়। এ অস্পষ্ট চেতনাই নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞান। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে আমরা বস্তুর কেবল অস্তিত্বকেই উপলব্ধি করি। সেই বস্তুটি যে কি, অর্থাৎ তার জাতি কি, তার কি কি গুণ আছে—এ সমস্ত সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট জ্ঞান হয় না। বস্তু সম্পর্কে প্রাথমিক এবং অনির্দিষ্ট জ্ঞানকেই
মীমাংসকরা নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বা আলোচনা জ্ঞান বলেছেন।
খ. সবিকল্প প্রত্যক্ষ (Determinate Perception) : আমাদের অতীত জ্ঞানের ভিত্তিতে অর্থাৎ নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে বস্তুটিকে যখন ব্যাখ্যা করা হয় অর্থাৎ বস্তুটির জাতি, ধর্ম, ক্রিয়া প্রভৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান হয় তখন তাকে সবিকল্প প্রত্যক্ষ বলা হয়। সবিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে বচনের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। যেমন- কোন একটি বস্তুকে প্রত্যক্ষ করে আমরা বলি যে, এটি একটি মানুষ, তার রং কালো, সে লম্বাকৃতি ইত্যাদি । মীমাংসকদের মতে নির্বিকল্প এবং সর্বিকল্প একই বস্তুর প্রত্যক্ষের দুটি স্তর মাত্র। নির্বিকল্প হলো প্রথম স্তর আর সবিকল্প হলো দ্বিতীয় স্তর এবং নির্বিকল্প ছাড়া সবিকল্প প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়। মীমাংসাকদের মতে, সবিকল্প প্রত্যক্ষের ভিত্তিই হলো নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ। তাদের মতে, সরিকল্প প্রত্যক্ষে বস্তুর যে সকল গুণ, ক্রিয়া প্রভৃতি উপলব্ধি করি তা আমাদের কল্পিত নয়। যদিও বৌদ্ধ এবং কোন বৈদান্তিক মনে করেন যে, সেগুলো বস্তুগত, অর্থাৎ বস্তুতেই অবস্থান করে। সবিকল্প প্রত্যক্ষেও আমরা তাদের উপলব্ধি করি। তবে ঐ স্তরে আমাদের উপলব্ধি হয় অস্পষ্ট। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে যা নেই তা সবিকল্প প্রত্যক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। উভয় প্রকার প্রত্যক্ষের মধ্যে পার্থক্য হলো এ যে, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে যা প্রচ্ছন্ন থাকে তা সবিকল্প প্রত্যক্ষে প্রকট হয়।
ন্যায় মতে যোগীরা যোগ সাধনালব্ধ অলৌকক শক্তির বলে সুদূর অতীত ও ভবিষ্যতের বস্তুকে, অতি দূরবর্তী ও অতি সূক্ষ্ম বস্তুকে
প্রত্যক্ষ করতে পারেন। নৈয়ায়িকদের মতে এ প্রত্যক্ষের নাম যৌগিক প্রত্যক্ষ বা অলৌকিক প্রত্যক্ষ। কিন্তু মীমাংসকরা যৌগিক প্রত্যক্ষকে যথার্থ প্রত্যক্ষ বলে স্বীকার করেন না। কারণ এ প্রত্যক্ষে বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হয় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মীমাংসকরা তাঁদের প্রমাণ সম্পৰ্কীয় মতবাদে প্রত্যক্ষ প্রমাণের খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা করেছেন। যে কোনভাবে জ্ঞান লাভ করতে হলেই প্রমাণ চলে আসে। আর প্রমাণ সম্পর্কীয় মতবাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ভারতীয় দর্শনে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।