মীমাংসা দর্শনের নিরীশ্বরবাদ আলোচনা কর।

অথবা, নিরীশ্বরবাদ সম্পর্কে মীমাংসকদের মত আলোচনা কর।
অথবা, নিরীশ্বরবাদ সম্পর্কে মীমাংসা মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, ঈশ্বর সম্পর্কে মীমাংসকদের মত আলোচনা কর ।
অথবা, মীমাংসা দর্শন কী নিরীশ্বরবাদী দর্শন আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মহর্ষি জৈমিনি মীমাংসাদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে মীমাংসা দর্শনের আর এক নাম ‘জৈমিনিদর্শন’। বেদের দুইভাগ । যথা : এক ভাগের নাম পূর্বকাণ্ড বা কর্মকাণ্ড এবং আর এক ভাগের নাম উত্তরকাণ্ড বা জ্ঞানকাণ্ড। মীমাংসাদর্শন বেদের পূর্বকাণ্ড বা কর্মকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। আলোচনার সুবিধার্থে মীমাংসা দর্শনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : ১. জ্ঞান (Knowledge) ২. তত্ত্ব (Metaphysics) এবং ৩. নীতি ও ধর্ম (Ethics and
Religion) I
মীমাংসা নিরীশ্বরবাদ : মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি জৈমিনি জগৎ স্রষ্টারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি। প্রাচীন মীমাংসকগণও ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন অনুভব করেন নি এবং তাঁদের আলোচনায় ঈশ্বরের কোন উল্লেখ নেই। তাঁদের মতে, কর্ম-নিয়ম অনুসারেই জগতের সৃষ্টি হয়েছে এবং এ কর্ম নিয়ম অনুসারেই জীব তার কর্মফল ভোগ করে। প্রভাকর ও কুমারিলও জগৎ স্রষ্টারূপে বা কর্মফল দাতারূপে বা পাপ-পূণ্যের নিয়ামকরূপে বা বেদের রচয়িতারূপে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি। অধিকন্তু মীমাংসকরা বলেন যে, ঈশ্বর যদি জগৎ স্রষ্টা হয় তবে তাঁকে পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট বলতে হয়, যেহেতু তিনি জগতে কাউকে সুখী এবং কাউকে দুঃখী করেছেন। কিন্তু ঈশ্বরের পক্ষপাতিত্ব দোষ আছে-এ কথাও স্বীকার করা যায় না। উপর্যুক্ত তথ্য ও যুক্তিদৃষ্টি মীমাংসা দর্শনকে নিরীশ্বরবাদী দর্শন বলতে হয়। কিন্তু ম্যাক্স মুলার (Max Muller) বলেন, মীমাংসা বেদ-নির্ভর দর্শন এবং যে দর্শন বেদ নির্ভর সে দর্শন কখনো নিরীশ্বরবাদী হতে পারে না। এ কথা সত্য যে, মীমাংসা দার্শনিকগণ জগৎ স্রষ্টারূপ ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়েছেন। জগৎ স্রষ্টারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিশ্বাস করেন না বলেই একেবারে ঈশ্বরকেই মানেন না এ কথা মনে করার কোন সঙ্গত কারণ নেই। অদ্বৈত বেদান্তও সৃষ্টিবাদে বিশ্বাস করে না। কিন্তু অদ্বৈত বেদান্ত নিরীশ্বরবাদী নয়। পাশ্চাত্য দার্শনিক স্পিনোজা ঈশ্বর সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে একমত ছিলেন না। কিন্তু সেজন্য তাঁকে নিরীশ্বরবাদী বলা চলে না। মীমাংসা দর্মন বেদানুসারী এবং বেদই মীমাংসা দর্শনের ভিত্তি। এ ভিত্তির দিক হতে বিচার করলে ম্যাক্স মুলার (Max Muller)-এর কথাই সত্য বলে মনে হয়। কিন্তু মীমাংসা দর্শন আলোচনা করে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে বিচার করলে মীমাংসা দর্শনকে ঈশ্বরবাদী বলা যায় না। পরবর্তীকালের মীমাংসকরা জৈন দার্শনিকদের মতো ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বহু প্রমাণ দিয়েছেন। এমতাবস্থায় মীমাংসকদের মধ্যে বৈদিক ঈশ্বর বিশ্বাস জাগ্রত-এ কথা বলা সমীচীন হবে না। তবে কেউ কেউ এ কথা বলতে পারেন যে, মীমাংসা দর্শন যেহেতু বৈদিক দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করার নির্দেশ দেয় সেহেতু এটি বহু দেবতায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ মীমাংসা বহু ঈশ্বরবাদী দর্শন। কারণ যেসব দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করা হয় তাঁরা ব্যক্তি নন। কারণ তাঁরা যদি ব্যক্তি হন তবে একই সময়ে বিভিন্ন যজ্ঞে উপস্থিত থাকেন কেমন করে? মীমাংসকদের মতে যজ্ঞ-বিধাতা কেবল গুণবাচক মন্ত্র। ঈশ্বরের মহিমা কীর্তন মীমাংসকরা কোন দিন করেন নি। কাজেই এটি স্বীকার করতে হয় যে, মীমাংসা দর্শন নিরীশ্বরবাদী। বেদের মহিমা প্রচার করাই মীমাংসকদের প্রধান কাজ।
বস্তুত মীমাংসা দর্শনে বেদই ঈশ্বরের স্থান অধিকার করেছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মীমাংসকরা তাঁদের আলোচনায় ঈশ্বর সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা করেছেন। তাইতো মীমাংসা দর্শনের নিরীশ্বরবাদ সম্পর্কীয় আলোচনা ভারতীয় দর্শনে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a6%b6%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a6%be/