মীমাংসা দর্শনের জ্ঞানের প্রামাণ্য ও ভ্রম আলোচনা কর।

অথবা, জ্ঞানের প্রামাণ্য ও ভ্রম সম্পর্কে
অথবা, জ্ঞানের প্রামাণ্য ও ভ্রম সম্পর্কে
অথবা, মীমাংসা দার্শনিকদের আলোকে
মীমাংসকদের মত আলোচনা কর।
মীমাংসা মতবাদ আলোচনা কর।
জ্ঞানের প্রামাণ্য ও ভ্রম ধারণা দ্বয় ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মহর্ষি জৈমিনি মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে মীমাংসা দর্শনের আর এক নাম ‘জৈমিনি দর্শন’। মীমাংসা দর্শন বেদের পূর্বকাণ্ড বা কর্মকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। আলোচনার সুবিধার্থে মীমাংসা দর্শনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : ১. জ্ঞান (Knowledge) ২. তত্ত্ব (Metaphysics) এবং ৩. নীতি ও ধর্ম
(Ethics and Religion)। প্রমাণ হলো যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালি বা উপায়। নিম্নে মীমাংসা দর্শনের জ্ঞানের প্রামাণ্য ও ভ্রম সম্পর্কে আলোচনা করা হলো চক্রী জ্ঞানের প্রামাণ্য (The Validity of Knowledge) : মীমাংসকরা বলেন, যথাযথ কারণগুলো উপস্থিত থাকলে এবং তার দোষমুক্ত হলেই জ্ঞান উৎপত্তি হয়। যেমন- দিবালোকে সুস্থ চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যদি কোন বস্তুর সংযোগ ঘটে তবে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়। সংশয়হীন উপাত্ত হতে অনুমান করা যায়, বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির অর্থপূর্ণ বাক্য হতে শব্দ জ্ঞান হয় ইত্যাদি। তাঁরা আরো বলেন, দৈনন্দিন জীবনে যখনই আমাদের কোন জ্ঞানের উৎপত্তি হয় আমরা যুক্তির সাহায্যে সেই জ্ঞানের সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা না করে ঐ জ্ঞান অনুসারে কাজ করি এবং আমাদের কাজ সার্থক হয়। এটি হতে বুঝা যায় যে, জ্ঞান হলেই আমরা তাকে সত্য বলে মেনে নিই। অবশ্য একথা সত্য যে, কোন ক্ষেত্রে যদি জ্ঞানের কারণগুলো ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে সেই জ্ঞানে আমাদের বিশ্বাস থাকে না এবং ঐ জ্ঞানকে আমরা জ্ঞানই বলি না। যেমন- পাণ্ডুরোগগ্রস্ত চক্ষুর দ্বারা প্রত্যক্ষ, ত্রুটিপূর্ণ উপাত্ত হতে অনুমান, অর্থহীন বাক্য হতে শব্দ জ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানই নয়। এসব তথ্যের ভিত্তিতে মীমাংসকগণ দুটি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। যথা:
প্রথমত, জ্ঞানের প্রামাণ্য বা যথার্থ জ্ঞানের মধ্যেই থাকে, অন্য কোন কারণের উপর নির্ভর করে না। অর্থাৎ যে কারণগুলো হতে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়, সেই কারণগুলোই জ্ঞানকে যথার্থ করে (প্রামাণ্যম্ স্বতঃ উৎপদ্যতে)।
দ্বিতীয়ত, জ্ঞান উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথেই জ্ঞান প্রামাণ্য বা যথার্থ বলে জ্ঞাত হয়। এটির প্রামাণ্য অন্য কোন প্রমাণের উপর নির্ভর করে না (প্রামাণ্যম্ স্বতঃ জ্ঞায়তে চ)। জ্ঞানের প্রামাণ্য সম্পর্কিত মীমাংসকদের এ মতবাদ
স্বতঃপ্রামাণ্যবাদ (The Theory of Intrinsic Validity) নামে পরিচিত। মীমাংসকদের মতে, জ্ঞানের প্রামাণ্য স্বতঃ হলেও এর অপ্রামাণ্য বা অযথার্থ পরতঃ এটি নির্ণয় করা হয় অনুমানের
সাহায্যে। যখনই কোন জ্ঞানের কারণ দোষযুক্ত দেখা দেয় তখনই আমরা অনুমান করি যে, ঐ জ্ঞান অযথার্থ বা ভ্রান্ত। জ্ঞানের অপ্রামাণ্য সম্পর্কীয় মীমাংসকদের এ মতবাদ পরতঃ অপ্রামাণ্যবাদ নামে পরিচিত।
ভ্রম (Error) : মীমাংসকদের মতে, সব জ্ঞানই স্বতঃপ্রামাণ্য। অর্থাৎ সব জ্ঞানই সত্যতা দাবি করে। এখন প্রশ্ন হলো সব জ্ঞানই যদি সত্যতা দাবি করে তবে ভ্রান্ত জ্ঞানের বা ভ্রমের উদ্ভব হয় কেমন করে? ভ্রম সম্পর্কে প্রভাকর এবং
ভট্ট সম্প্রদায় ভিন্ন মত পোষণ করেন। প্রভাকরদের মতে, সব জ্ঞানই সত্য, তথাকথিত ভ্রান্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও.স্মৃতি-এ দুই প্রকার জ্ঞানের সংমিশ্রণ হয়। যেমন- রজ্জুতে যখন সর্প ভ্রম হয় তখন রজ্জুর প্রত্যক্ষ হয় এবং সর্পের স্মরণ হয়, যেহেতু রজ্জুর সঙ্গে সর্পের সাদৃশ্য আছে। কিন্তু স্মৃতি নাশ বা স্মৃতি প্রমোষের জন্য (Due to lapse of memory)
প্রত্যক্ষ ও স্মৃতি যে পৃথক জ্ঞান, এ বোধ থাকে না। ফলে রজ্জুতে সর্প ভ্রম উৎপন্ন হয়। প্রভাকরদের ভ্রম সম্পর্কে এ মতবাদ অখ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। ভট্ট সম্প্রপদায় প্রভাকরদের উপর্যুক্ত মতবাদ স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, জ্ঞান হলো ভ্রান্ত প্রত্ যক্ষণ, ভ্রমে একটি বস্তুকে আর একটি বস্তুরূপে প্রত্যক্ষ করা হয়। যেমন- রজ্জুতে যখন সর্পভ্রম হয়, তখন রজ্জুকে সর্পরূপে প্রত্যক্ষ করা হয় না। জ্ঞান সম্পর্কে ভট্টদের মতবাদ বিপরীত খ্যাতিবাদ নামে পরিচিত। প্রভাকর এবং ভট্ট সম্প্রদায় ভ্রম সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করলেও উভয় সম্প্রদায় এ কথা স্বীকার করেন যে, জ্ঞানের সত্যতা স্বাভাবিক এবং ভ্রম তার ব্যতিক্রম।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মীমাংসকরা তাঁদের প্রমাণ সম্পর্কীয় মতবাদে জ্ঞানের প্রামাণ্য ও ভ্রম সম্পর্কে খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা করেছেন। যে কোনভাবে জ্ঞান লাভ করতে হলেই প্রমাণ চলে আসে। তাইতো মীমাংসা দর্শনের জ্ঞানের প্রামাণ্য ও ভ্রম সম্পর্কীয় আলোচনা ভারতীয় দর্শনে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a6%e0%a6%b6%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%ae%e0%a7%80%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a6%be/