অথবা, উপমান সম্পর্কে মীমাংসকদের মত আলোচনা কর।
অথবা, উপমান সম্পর্কে মীমাংসা মতবাদ আলোচনা কর।
অথবা, উপমান প্রমাণ সম্পর্কে মীমাংসা দার্শনিকদের অভিমত বিস্তারিত আলোচনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : মহর্ষি জৈমিনি মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে মীমাংসা দর্শনের আর এক নাম ‘জৈমিনি দৰ্শন’। মীমাংসা দর্শন বেদের পূর্বকাণ্ড বা কর্মকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত। আলোচনার সুবিধার্থে মীমাংসা দর্শনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : ১. জ্ঞান (Knowledge) ২. তত্ত্ব (Metaphysics) এবং ৩. নীতি ও ধর্ম
(Ethics and Religion)। প্রমাণ হলো যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালি বা উপায় । জৈমিনির মতে, প্রমাণ তিন প্রকারের। যথা :
১. প্রত্যক্ষ, ২. অনুমান ও ৩. শব্দ। কিন্তু প্রভাকরের মতে প্রমাণ পাঁচ প্রকারের। যথা : ১. প্রত্যক্ষ, ২. অনুমান, ৩. শব্দ, ৪. উপমান ও ৫. অর্থাপত্তি। কুমারিল ভট্ট প্রভাকর মিত্র প্রদত্ত পাঁচ প্রকার প্রমাণের সাথে আর একটি প্রমাণ যোগ করেন। সেটি হলো অনুপলব্ধি। সুতরাং কুমারিলের মতে প্রমাণ ছয় প্রকার। যথা : ১. প্রত্যক্ষ, ২. অনুমান, ৩. শব্দ, ৪. উপমান, ৫. অর্থাপত্তি এবং ৬. অনুপলব্ধি। নিম্নে মীমাংসা দর্শনের উপমান প্রমাণ আলোচনা করা হলো :
৪. উপমান (Comparison) : নৈয়ায়িকদের মতো মীমাংসকরাও উপমানকে একটি স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে গণ্য করেন। তবে মীমাংসা প্রদত্ত উপমানের ব্যাখ্যা নৈয়ায়িক প্রদত্ত ব্যাখ্যা হতে ভিন্ন। নৈয়ায়িকদের মতে, সংজ্ঞা হতে সংজ্ঞীর (যার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে) যে জ্ঞান তাই উপমান। কিন্তু মীমাংসকদের মতে, পূর্ব প্রত্যক্ষীভূত বস্তুর সাথে বর্তমানে প্রত্যক্ষীভূত
বস্তুর সাদৃশ্যজ্ঞানই উপমান। উদাহরণস্বরূপ, কোন ব্যক্তি তার নিজ বাড়িতে একটি গরু দেখেছেন। কিছুদিন পরে তিনি বনে গিয়ে একটি গবয় (বন্য গাভী) দেখলেন এবং লক্ষ করলেন যে, বাড়িতে দৃষ্ট গরুর সাথে এর সাদৃশ্য আছে। এরপর তিনি বাড়িতে দেখা গরুটিকে স্মরণ করলেন এবং জানলেন যে, স্মৃতিতে উপস্থিত পূর্বদৃষ্ট গরু বর্তমানে প্রত্যক্ষীভূত গবয় সদৃশ। তার এ জ্ঞান উপমানলব্ধ জ্ঞান। মীমাংসকদের মতে, উপমানকে প্রত্যক্ষ বলা যায় না। কারণ, পূর্ব-দৃষ্ট বস্তুটি (এখানে বাড়িতে দেখা গরুটি) জ্ঞান উৎপাদনের সময় ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে অনুপস্থিত, একে স্মৃতিও বলা যায় না। কারণ পূর্বদৃষ্ট গরুটিকে স্মরণ করা হলেও গরুর সাথে গবয়ের সাদৃশ্য পূর্বজ্ঞাত নয়। মীমাংসকদের মতে, উপমান অনুমানও নয়। কারণ দুটি সদৃশ্য বস্তুর (এখানে গরু ও গবয়) মধ্যে নিয়ত সম্পর্কের জ্ঞান, যাকে ব্যাপ্তি জ্ঞান বলা হয়, এখানে তার অভাব আছে। একে শব্দ-জ্ঞানও বলা যায় না, যেহেতু উপমানলব্ধ জ্ঞান কোন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি বা বেদের উপর নির্ভর করে না। সুতরাং উপমান একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ। এ বলে স্বীকার করতে হয়। মীমাংসকরা বলেছেন, নৈয়ায়িকরা উপমানকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সে ব্যাখ্যা দৃষ্টে উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে গণ্য করা যায় না। ন্যায় মতে, কোন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির কাছে ‘গবয় গরু সদৃশ’ এ কথা শুনে যদি কোন লোক বনের মধ্যে কোন একটি জন্তুকে দেখেন এবং বলেন যে, ‘এটিই গবয়’ তবে তাঁর জ্ঞানকে উপমানলবব্ধ জ্ঞান বলা হবে। মীমাংসকরা বলেন যে, বনে দৃষ্ট জন্তুটি গরুর মতন-এ জ্ঞান প্রত্যক্ষ জ্ঞান। ‘গবয় গরু সদৃশ’-এ জ্ঞান শব্দ জ্ঞান, যেহেতু বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি হতে পাওয়া। ‘বনে দৃষ্ট জন্তুটি গবয়’-এ জ্ঞান পূর্ব জ্ঞান হতে নিঃসৃত অনুমান মাত্র। কাজেই উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করা যায় না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মীমাংসকরা তাঁদের প্রমাণ সম্পর্কীয় মতবাদে উপমান প্রমাণের খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা করেছেন। যে কোনভাবে জ্ঞান লাভ করতে হলেই প্রমাণ চলে আসে। আর প্রমাণ সম্পর্কীয় মতবাদের মধ্যে উপমান প্রমাণ
ভারতীয় দর্শনে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।