অথবা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কার্যকারিতা আলোচনা কর।
অথবা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণে প্রায়োগিক দিক উল্লেখ কর।
উত্তর: ভূমিকা : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ক্ষেত্রেই এ নীতির প্রয়োগ বেশি প্রতীয়মান হয়। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। সেহেতু সংবিধান প্রণেতাগণ মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি যারা প্রভাবিত হয়ে সংবিধানে এ নীতির সংযোজন করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির প্রয়োগ: ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির প্রয়োগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ক্ষেত্রে এই নীতির প্রয়োগ আরও স্পষ্ট। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা রয়েছে, তাই সংবিধানের প্রণেতারা মন্টেসকুইয়ের ক্ষমতার স্বীকৃতির নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং এই নীতিটি সংবিধানে যুক্ত করেছিল। এটি নীচে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে:
১. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুচ্ছেদ 1 কংগ্রেসের হাতে সমস্ত আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ন্যস্ত করে। কংগ্রেস প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেট নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের অংশ নন। তাই তিনি কংগ্রেসের কোনো হাউস ভেঙে দিতে পারবেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতিকে স্বীকৃতি দেয়
২. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২: মার্কিন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২ অনুসারে, সমস্ত নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত নয়। রাষ্ট্রপতি প্রশাসনিক বিভাগের প্রধান হিসাবে প্রশাসনের সুবিধার্থে সচিবদের নিয়োগ করেন। সচিবরা রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন। তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনো সম্পর্ক নেই।
৩. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ : মার্কিন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত বিচারিক ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে ন্যস্ত করে৷ সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন এখতিয়ার ভোগ করে। সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচার পরিচালনা করে, রাষ্ট্রপতি এবং কংগ্রেসের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এভাবে মার্কিন সংবিধানের প্রথম তিনটি ধারায় ক্ষমতা পৃথকীকরণের বিষয়ে সংবিধান প্রণেতাদের মতামত প্রকাশ করা হয়েছে।
৪. ব্যক্তিগত ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তিগত ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বিদ্যমান রয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেস পরস্পরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে অবস্থান করেন। এভাবে সাংবিধানিক নীতি অনুযায়ী আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা পৃথক করে দেয়া হয়েছে এবং এরা সকলেই স্বাধীন।
৫. ব্যক্তিস্বাধীনতাঁর চাবিকাঠি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতাগণ ব্যক্তিস্বাধীনতার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকেই তারা ব্যক্তিস্বাধীনতার চাবিকাঠি বলে আখ্যায়িত করতেন। তবে ব্যক্তিস্বাধীনতা বুঝাতে তারা সমাজের বিত্তবান মানুষের স্বাধীনতাকেই বুঝাতেন।
৬. সরকারের ভিত্তি : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার মূলভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই নয়, বরং অঙ্গরাজ্যের সরকারগুলোও এ নীতিকে সুনিপুণভাবে গ্রহণ করেছেন। তাই বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বিদ্যমান রয়েছে।
৭. ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি গ্রহণ : মার্কিন শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির প্রয়োগ লক্ষ্য করা
যায়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবক্তাদের অভিমত হলো, সরকারের প্রত্যেক বিভাগই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর আবদ্ধ। তারা সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ করেন।আর এজন্য এ নীতির প্রবক্তারা যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি নামে খ্যাত।
৮. নাতিদীর্ঘ রচনা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সে দেশে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ অনেক বেশি। আর সংবিধান প্রণেতাগণ সেজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপর একটি নাতিদীর্ঘ রচনা লিখেছে
৯. অর্থনৈতিক বিন্যাস : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কখন, কিভাবে প্রয়োগ করা হবে তা নির্ভর করে মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী অর্থনৈতিক, সামাজিক বিন্যাসের উপর। এ নীতি যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের প্রাধান্যকারী অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা কার্যকর থাকবে।
১০. পারস্পরিক নির্ভরশীলতা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি চালু থাকলেও সরকারের বিভিন্ন বিভাগসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বজায় রয়েছে। অর্থাৎ সরকারের এক বিভাগকে অপর বিভাগের উপর নির্ভর করতে হয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বাণী প্রেরণের মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এবং বিলে ভেটো প্রদানের মাধ্যমে কংগ্রেসকে প্রভাবিত করেন। আবার কংগ্রেস উচ্চকক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির নিয়োগের ক্ষেত্রে সিনেটের সৌজন্যমূলক আচরণের দ্বারা তার নিয়োগকে প্রভাবিত করে।
উপসংহার: উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কতিপয় সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেকটা কার্যকরী। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির তুলনায় ক্ষমতার ভারসাম্য নীতির প্রয়োগ অত্যধিক। তবে এ কথা সত্য যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বর্তমানে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কেননা এটি গণতন্ত্র ও সুশাসনের পরিপন্থী।