অথবা, মায়া অবর্ণনীয় এর দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে?
অথবা, ব্রহ্মের শক্তি হিসেবে মায়ার অবর্ণনীয়তা সম্পর্কে যা জানো লেখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : মহর্ষি বাদরায়ন (আনু. ৫০০ খ্রি. পূ.) প্রণীত বেদান্তসূত্রে (৫৫৫টি সূত্র) ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিপাদিত হয়েছে বলে একে ব্রহ্মসূত্র বলে। আবার জীবের স্বরূপ বর্ণিত হওয়ায় একে শারীরিকসূত্রও বলা হয়। ব্রহ্মসূত্রের সাতটি ভাষ্যের (শঙ্করের শঙ্কভাষ্য, রামানুজের শ্রীভাষ্য, বল্লভের অনুভাষ্য, মাধ্বের পূর্ণপ্রজ্ঞাভাষ্য, নিম্বার্কের বেদান্তপারিজাতসৌরভ, ভাস্করের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য এবং বলদেবের গোবিন্দভাষ্য) মধ্যে শঙ্করের শঙ্করভাষ্য এবং রামানুজের শ্রীভাষ্য অন্যতম।
নিম্নে প্রশ্নের আলোকে আমাদের আলোচ্যবিষয় আলোচনা করা হলো :
১. “মায়া ব্রহ্মেরই একরকম শক্তি এবং এটি অবর্ণনীয়”-উক্তিটির ব্যাখ্যা : শঙ্করের মতে, জগৎ মিথ্যা। এ জগৎ স্বপ্ন দৃষ্টবস্তু বা ভ্রম প্রত্যক্ষের বস্তুর ন্যায় মিথ্যা অবভাস মাত্র। এটি মায়ার সৃষ্টি। শঙ্করাচার্য বলেছেন, জগৎ যে মিথ্যা ও মায়ার সৃষ্টি, এর ইঙ্গিত বেদ ও উপনিষদেও পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, ইন্দ্র মায়ার দ্বারা নানাবিধ রূপ ধারণ করে। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও এ কথার স্বীকৃতি রয়েছে। শঙ্করাচার্য বলেছেন, মায়া ব্রহ্মেরই একরকম শক্তি এবং এটি অবর্ণনীয়। ব্রহ্মের এ মায়াশক্তি জাদুকরের জাদুশক্তির ন্যায় মানুষকে ভ্রান্তিতে ফেলতে পারে। জাদুকর যেমন তার জাদুশক্তির দ্বারা একটি টাকাকে অনেকগুলো টাকা বানিয়ে দেখাতে পারে, তেমনি ব্রহ্মও তাঁর মায়াশক্তি দ্বারা অজ্ঞ মানুষকে অসত্য জগৎকে সত্য বলে মনে করাতে পারে। তিনি আরো বলেছেন, জাদুকর যেমন তার জাদুশক্তি দ্বারা অন্য জাদুকরকে প্রতারিত করতে পারে না এবং নিজেও প্রতারিত হয় না, তেমনি ব্রহ্মও তাঁর মায়াশক্তি দ্বারা কোন তত্ত্বজ্ঞানীকে ভ্রান্তিতে ফেলতে পারে না এবং নিজেও ভ্রান্তিতে পড়ে না। তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি কেবল ব্রহ্মের সততাই উপলব্ধি করেন, জগৎ এবং মায়ার সত্তা উপলব্ধি করেন না। জাদুকরের একটি টাকাকে বহু টাকা দেখাতে পারার কারণ হলো তার জাদুশক্তি এবং মানুষের একটি টাকাকে বহু টাকা দেখার কারণ হলো তার অজ্ঞানতা। অনুরূপভাবে বলা যায়, ব্রহ্মের মায়াশক্তি জগৎ দেখায়, আর সাধারণ মানুষ অজ্ঞ বলে তা দেখে। জাদুকর যেমন জানে তার জাদুশক্তি ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই নয়, তেমনি ব্রহ্মও জানে যে, তাঁর মায়াশক্তি কিছুই নয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, শঙ্করের মতে, মায়া ব্রহ্মেরই এক রকম শক্তি এবং এটি অবর্ণনীয়। ব্রহ্মের এ মায়া শক্তি জাদুকরের জাদুশক্তির মতো মানুষকে ভ্রান্তিতে ফেলতে পারে। ভারতীয় দর্শনে মায়া কথাটির একক কোন অর্থ নেই । ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে এ মায়া কথাটির ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।