মানুষের আত্মার অবিনশ্বরতা প্রসঙ্গে দার্শনিকদের দেয়া যুক্তিগুলো কী কী? ইমাম আল গাজালি- কিভাবে তা খণ্ডন করেন?

অথবা, মানুষের আত্মার অবিনশ্বরতা প্রসঙ্গে দার্শনিকদের যুক্তিগুলোকে ইমাম আল গাজালি কিভাবে খণ্ডন করেন তা ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, মানুষের আত্মার অবিনশ্বরতা প্রসঙ্গে দার্শনিকদের যুক্তিগুলোকে ইমাম আল গাজালি কিভাবে খণ্ডন করেন আলোচনা কর।
অথবা, মানুষের আত্মার অবিনশ্বরতা প্রসঙ্গে দার্শনিকদের যুক্তিগুলোকে ইমাম আল গাজালি কিভাবে খণ্ডন করেন বিশ্লেষণ কর।
উত্তর ভূমিকা :
মুসলিম দর্শনে আত্মা সম্পর্কীয় আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম চিন্তাবিদ এবং গ্রিক দার্শনিকগণ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আত্মা সম্পর্কীয় আলোচনা করেছেন। ফালাসিফা সম্প্রদায়ের দার্শনিকরা আত্মার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস করেন। তারা বলেন, আত্মা একবার সৃষ্টি হলে আর কখনো ধ্বংস হয় না। আল গাজালিও আত্মার অমরতায় বিশ্বাস করেন। তাঁর ধারণা আত্মা কখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না।
আত্মার অবিনশ্বরতা প্রমাণে দার্শনিকদের যুক্তি : দার্শনিকরা আত্মার অবিনশ্বরতা প্রমাণে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো :
দার্শনিকদের প্রথম যুক্তি: দার্শনিকদের মতে, আত্মা নিম্নলিখিত তিনটি কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় :
ক. আত্মার ধ্বংস দেহের মৃত্যুর দ্বারা সংঘটিত হবে।
খ. আত্মার ধ্বংস কোন বিপরীত ঘটনা দ্বারা সংঘটিত হবে।
গ. আত্মার ধ্বংস আল্লাহ কর্তৃক সংঘটিত হয়।
দার্শনিকদের মতে, উপর্যুক্ত তিনটি বিকল্প দ্বারা কখনো আত্মা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। প্রথম বিকল্প দ্বারা আত্মা যে কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে না : দার্শনিকদের মতে, দেহের মৃত্যুর দ্বারা আত্মা নিম্নলিখিতভাবে ধ্বংস হতে পারে না :
১. আত্মা দেহের অধীন নয়। ফলে আত্মা ও দেহের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। দার্শনিকরা মনে করেন, আত্মা ও দেহের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দেহের চালক হলো আত্মা। তাই দেহের ধ্বংস
২. দ্বারা কখনো আত্মার ধ্বংস সম্ভব নয়।
৩. দেহ ও আত্মার সাথে সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান। দার্শনিকদের মতে, ইতর প্রাণীর আত্মা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় কিন্তু আত্মা যদি দেহের অংশীদার না হয় তাহলে আত্মা ধ্বংস হয় না।
৪. আত্মা ও দেহের কাজ হচ্ছে জ্ঞানের বিষয় উপলব্ধি করা। আত্মার কাজ সম্পন্ন করার জন্য দেহের প্রয়োজন নেই। সুতরাং আত্মার অস্তিত্বের জন্য দেহের খুবই প্রয়োজন।
দ্বিতীয় বিকল্প দ্বারা আত্মা যে কারণে ধ্বংস হতে পারে না : দার্শনিকরা মত প্রকাশ করেন যে, বিপরীত কোন ঘটনা দ্বারা আত্মা কখনো বিনাশ হয় না। কারণ প্রত্যেকটি পদার্থই পরিবর্তন হয়। এর কোন বিপরীত দিক নেই। এটা কখনো।শেষ হয়ে যায় না। যেমন- দুধের আকৃতি এর বিপরীত আকৃতি দ্বারা নষ্ট হয় না। ফলে এর মূল উপাদান ঠিকই থাকে।এর কোন রূপান্তর হয় না।
তৃতীয় বিকল্প দ্বারা আত্মা যে কারণে ধ্বংস হয় না : যত বড় শক্তি দ্বারাই চেষ্টা হোক না কেন আত্মা নো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। কারণ আত্মা ধ্বংস হওয়ার জিনিস নয়। দার্শনিকদের প্রথম যুক্তির বিরুদ্ধে আল গাজালির অভিমত : দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ আল গাজালি নিম্নোক্তভাবে সমালোচনা করেন :
প্রথমত, প্রথম যুক্তিতে দার্শনিকরা আত্মা ধ্বংস হওয়ার ব্যাপারে তিনটি বিকল্প উপায়ের কথা বলেছেন। কিন্তু আল গাজালি দার্শনিকদের প্রশ্ন করেন। কেন তারা তিনটি বিকল্পের কথা বলেছেন? কেন তারা তিনটির বেশি বা কম বিকল্পের কথা বললেন না?
দ্বিতীয়ত, আত্মা ধ্বংস হতে পারে একথাটি দার্শনিকরা স্বীকার করেন না। কিন্তু গাজালি বলেন, এটি যুক্তিসংগত নয়। কারণ তিনি দয়ালু, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান। তিনি যখন যা খুশি তাই করতে পারেন। তার ইচ্ছার বাইরে কোনকিছু হয় না বা ঘটে না।
তৃতীয়ত, দার্শনিকরা মনে করেন, আত্মা দেহে অবস্থান করে না। তবে এটা সত্যি যে, আত্মার সাথে দেহের অবশ্যই কোন না কোন সম ্পর্ক রয়েছে। কারণ আত্মা ও দেহ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গাজালি ও অন্যান্য মুসলিম দার্শনিকরা একথা স্বীকার করেন। কেননা আত্মা ব্যতীত দেহ সৃষ্টি হয় না। আর দেহ ব্যতীত আত্মা সৃষ্টি হয় না।
চতুর্থত, আত্মা অমর। দেহের ধ্বংসের সাথে আত্মার ধ্বংস হয় না। দার্শনিকদের একথাটি যুক্তিযুক্ত নয়। ইমাম আল গাজালির মতে, দার্শনিকদের এ যুক্তির ভিত্তি হলো অনাদ্বিত্ব।
দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তি : দার্শনিকদের মতে, আত্মা হলো একটি স্থান নিরপেক্ষ বস্তু। এর কোন বিনাশ বা ধ্বংস নেই। কোন স্থান নিরপেক্ষ বস্তুর শক্তি তার অস্তিত্বের আগেই বর্তমান থাকে। মূল পদার্থগুলোর কখনো কোন অস্তিত্বহীনতা কল্পনা করা যায় না। সুতরাং দার্শনিকরা বলেন, আত্মা কখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। কারণ এটা অমর ও অবিনশ্বর।
দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তির বিরুদ্ধে গাজালির অভিমত : আত্মার অবিনশ্বরতা সম্পর্কে আল গাজালি দার্শনিকদের দ্বিতীয় যুক্তিকে ভুল বলে প্রমাণ করেন। আল গাজালির মতে, এ যুক্তির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মাকে তাঁরা একটি অনাদি বস্তুই ভাবতে চান। তাঁদের বিশ্বাস, এ অনাদি বস্তু ধ্বংস প্রাপ্ত হয় না। গাজালির মতে, আমরা এ আলোচনার গোপন
উদ্দেশ্য সম্পর্কেও আলোচনা করেছি। এর আর পুনরাবৃত্তি করব না। কারণ এখানেও একই সমস্যা। দার্শনিকরা বলেন, জগতের অনাদিত্ব জড় বা বস্তু সম্পর্কিত। কিন্তু গাজালি দার্শনিকদের এ যুক্তিকে কখনো স্বীকার করেন না। সুতরাং আত্মা অনাদি ও অনন্ত ।
সমালোচনা : আল গাজালি দার্শনিকদের যুক্তিসমূহ নিম্নলিখিতভাবে সমালোচনা করেছেন :
১. দার্শনিকরা মনে করেন, আত্মা ও দেহের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দেহের চালক হলো আত্মা। দেহের ধ্বংস দ্বারা আত্মার ধ্বংস সম্ভব নয়। সুতরাং গাজালির মতে, দার্শনিকদের এ ধারণা ঠিক নয়।
২. দার্শনিকদের মতে, আত্মা দেহের অধীন নয়। ফলে আত্মা ও দেহের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু গাজালির মতে, আত্মা ও দেহের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
৩. দার্শনিকরা আত্মাকে ধ্বংস হতে হলে তিনটি বিকল্প কারণের কথা বলেছেন। গাজালির মতে, আত্মাকে ধ্বংস হতে হলে তিনটি কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কোন যুক্তি নেই।
৪.দার্শনিকদের মতে, আত্মা দেহে অবস্থান করে না। কিন্তু গাজালির মতে, আত্মা ও দেহের মধ্যে অবশ্যই কোন না কোন যোগাযোগ রয়েছে।
৫. দার্শনিকদের মতে, আত্মার কাজ সম্পন্ন করার জন্য দেহের প্রয়োজন। কিন্তু গাজালির মতে, আত্মার কাজ।সম্পন্ন করার জন্য দেহের প্রয়োজন এবং দেহের কাজ সম্পন্ন করার জন্য আত্মার প্রয়োজন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, মানুষের আত্মার অবিনশ্বরতা প্রসঙ্গে আল গাজালি যেভাবে দার্শনিকদের যুক্তি খণ্ডন করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দার্শনিকদের যুক্তি খণ্ডন করে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।পালন করেছেন । আত্মা কখনো দেহ থেকে ধ্বংস হয় না। সুতরাং আত্মা অবিনশ্বর ও অমর।