অথবা, মানব সম্পদ উন্নয়ন কী? বাংলাদেশে বর্তমান মানব সম্পদ উন্নয়নের অবস্থা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, মানব সম্পদ উন্নয়ন বলতে কী বুঝ? বাংলাদেশে বর্তমান মানব সম্পদ উন্নয়নের
অবস্থার বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : জাতির গৌরবময় প্রাচীন ইতিহাস তথা বিশ্ব সংস্কৃতির উন্নয়নের গতি ধারার সাথে সংগতি রেখে বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান, কারিগরি দক্ষতা ও বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে মানব উন্নয়ন সূচক নির্ণয় করা হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক ও ভৌত উভয় প্রকার উৎপাদনশীল সম্পদ সৃষ্টি করতে হলে প্রয়োজন সামাজিক খাতে ব্যাপক ব্যয়। সরকার বিগত কয়েক বছরে সামাজিক খাত উন্নয়নের জন্য সরকারি ব্যয়ের শতকরা ২০ ভাগের অধিক হারে অর্থ বরাদ্দ করে আসছে।
মানব সম্পদ উন্নয়ন : উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বস্তুগত মূলধনের প্রয়োজনীয়তা যেমন সীমাহীন তেমনি মানব সম্পদের উন্নয়ন অতি জরুরি। মানব সম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র। মানব সম্পদের উন্নয়নই অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। নিম্নে মানব সম্পদ উন্নয়নের সংজ্ঞা দেয়া হলো :
একটি দেশের সমগ্র শ্রমশক্তিকে মানব সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোন দেশের মূলধন, ভূমি ও জলভাগ ইত্যাদি যেমন তার সম্পদ, ঠিক তেমনি শ্রমশক্তিকে মানব সম্পদ বলা হয়। মানুষ শৈশব হতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ সেবা ও খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমে সুযোগ্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলে। এর ফলে তার কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা ও মানসম্মত বাসস্থান, চিকিৎসা ও মননশীলতা ইত্যাদির মাধ্যমে তার দক্ষতা, কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীলতা ইত্যাদি বৃদ্ধি করতে অন্যান্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, কোন দেশের শ্রমশক্তি যখন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণ, সক্ষম হয় তখন তাকে মানব সম্পদ উন্নয়ন বলে।
বাংলাদেশ ২০০০ সাল থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশের সরকারের উন্নয়ন এজেন্ডার মূল অঙ্গীকার হচ্ছে মানব সম্পদ উন্নয়ন। এ লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এবং ধীরগতিতে হলেও মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটছে।
বাংলাদেশে মানব সম্পদ উন্নয়নের অবস্থা : বাংলাদেশে মানব সম্পদ উন্নয়নের অবস্থা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. জনসংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি : জনসংখ্যা অধিক বৃদ্ধিজনিত কারণে দেশের নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বাসস্থান, খাদ্য ও চিকিৎসা ইত্যাদির অপ্রতুলতা মানব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রতিবন্ধকস্বরূপ।
২. দক্ষতার অভাব : দেশের উৎপাদনশীলতা শ্রমিকের কর্মদক্ষতার উপর নির্ভর করে। উন্নত দেশে জিনিসের স্থায়িত্ব ও গুণগত মান সবকিছুই বাংলাদেশ থেকে অনেক ভালো। দক্ষতার অভাবে উন্নত চিন্তা ও মননশক্তি প্রস্ফুটিত হয় না। ফলে মানব উন্নয়ন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. নিম্ন মাথাপিছু আয় : বর্তমানে বাংলাদেশের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় ৭৫১ মার্কিন ডলার যেখানে সুইডেনের মাথাপিছু আয় ৪০,০০০ মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় নিম্নতর হওয়ার কারণে এদেশের মানব সম্পদ অনুন্নত।
৪. চারিত্রিক গুণাবলি : উন্নত চরিত্রের অধিকারী মানুষ কাজের প্রতি সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কর্তব্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ অভাববোধ দেশের সার্বিক উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ফলে মানব উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫. আবহাওয়া : স্বাভাবিকভাবেই শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের মানুষ থেকে অধিক পরিশ্রমী। শীতকালীন সময়ে অধিক কাজ করলে ক্লান্তি কম আসে। কিন্তু এদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র জলব
ায়ুতে একটানা অধিক সময় কাজ করা যায় না।
৬. চিকিৎসার অগ্রতুলতা : বাংলাদেশে রেজিস্টারকৃত ডাক্তার ৫৫,৩২৫ জন মাত্র, প্রতি ৩,০০০ জন লোকের জন্য ১ জন করে ডাক্তার । ডাক্তারের সীমাহীন স্বল্পতায় দেশের চিকিৎসা সেবার নিদারুণ চিত্র ফুটে উঠে। মানব সম্পদ উন্নয়নে চিকিৎসা সেবার স্বল্পতা একটি অন্যতম অন্তরায়।
৭. জীবনযাত্রার মান : বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। এজন্য তাদের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন । তাছাড়া তারা জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম উপাদান ভোগ করতে পারে না। ফলে তাদের কর্মদক্ষতা
হ্রাস পায় ।
৮. দারিদ্র্যজনিত সমস্যা : কোনো দেশের দরিদ্রতার কারণে মানুষের আয় কম। আয় কম বলে সঞ্চয় কম। সঞ্চয় কম বলে বিনিয়োগ কম। মূলত দরিদ্রতার দুষ্টচক্রে আবদ্ধ। দেশের শতকরা ৪৯ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাই এ দেশের মানব সম্পদ উন্নয়ন নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক।
৯. আয়ুষ্কাল : বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ৫৭ বছর। মানুষের কর্মক্ষমতা আয়ুষ্কালের উপর নির্ভর করে। জাপানের গড় আয়ুষ্কাল ৭৫ বছর। এ হতাশাব্যঞ্জক আয়ুষ্কাল এদেশের অনুন্নত মানব সম্পদের ইঙ্গিত বহন করে ।
১০. পরিবেশগত সমস্যা : বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। অতি সম্প্রতি বিশ্বে সামগ্রিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নিয়মিত বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় আমাদের দেশে আঘাত হানে। ফলশ্রুতিতে সামাজিক উন্নয়ন খাতে ব্যয় কমিয়ে দুর্যোগ কবলিত জায়গায় সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হয়। তাই মানব সম্পদ উন্নয়নের পথ বাধাগ্রস্ত হয়।
১১. শিক্ষার অভাব : দেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে রূপান্তরের ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যে কারিগরি ও প্রকৌশলগত জ্ঞানের প্রসার একান্ত আবশ্যক। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত বিধায় দেশের মানব সম্পদ উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
১২. জনস্বাস্থ্যের অনুন্নয়ন : বাংলাদেশে জনসাধারণ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নয়। স্বাভাবিকভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শ্রমিকের দক্ষতা বেশি হয়। কিন্তু এদেশে দারিদ্র্যের কারণে বেশিরভাগ মানুষ উপর্যুক্ত চিকিৎসা ও সমাজসেবা ইত্যাদি পায়। না। তাছাড়া অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করে বিধায় তাদের স্বাস্থ্য ক্ষতিকর ও দুর্বল। ফলে তাদের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কম।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে মানব সম্পদ এখন অনুন্নত পর্যায়ে রয়েছে। কোনো দেশের শ্রমশক্তি অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। তা এ শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে হলে যে কোন মূল্যে মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।